প্রতিবন্ধীদের ভোটাধিকার
বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভোটদান প্রক্রিয়া এখনও জটিল। তারা কী করে স্বাচ্ছন্দ্যে ভোট দিতে পারেন, সে বিষয়ে অনেক সভা-সেমিনার, আলোচনা সভা হয়েছে। তারপরও অবস্থার ইতরবিশেষ হয়নি। এ জন্য আইনি দুর্বলতা যেমন দায়ী, তেমনি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠন তথা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দুর্বল ভূমিকা এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও অনেকাংশে দায়ী।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এখন অনেকটা প্রকল্পভিত্তিক হয়ে পড়েছে। দাতারা যেভাবে চায়, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো সেভাবেই তাদের কর্মসূচি প্রণয়ন করে। ফলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভোটের অধিকার নিয়ে আলোচনা প্রকল্পের সময় শেষ হলে বন্ধ হয়ে যায়। যদি বলা হয়, আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের এখনও চ্যারিটি মডেলে দেখে, তাহলে ভুল হবে না। এসব মানুষ দান-দক্ষিণা নেবেন এবং স্রষ্টাকে ডাকবেন– এটাই হচ্ছে একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সম্পর্কে সমাজের ধারণা।
যা হোক, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। আমরা যদি নির্বাচন কমিশনের পরিকল্পনা বিবেচনায় নিই, তাহলে আগামী ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারি মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই অল্প সময়ের মাঝেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য প্রবেশগম্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব।
নির্বাচনের দিন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যেসব সমস্যার সম্মুখীন হন, সেগুলোর মধ্যে যানবাহন বন্ধ থাকা, অপ্রবেশগম্য ভোটকেন্দ্র এবং প্রতিবন্ধীবান্ধব ভোটদান প্রক্রিয়ার অনুপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। এসব সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে প্রথমেই কোন এলাকায় কোন ধরনের এবং কতজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি আছেন, সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩-এর ৩১ নম্বর ধারাবলে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের একটি বিশেষ কার্ড দেয়, যা সুবর্ণ নাগরিক কার্ড হিসেবে পরিচিত। সেই পরিচয়পত্রের তথ্য বিশ্লেষণ করে কাজটি করা যায়। এর পর প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিশেষ করে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার সমস্যা সমাধানে নির্বাচন কমিশন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যুক্ত করতে পারে। তারা তাদের গাড়িতে করে প্রতিবন্ধী ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে আসতে এবং বাড়ি ফিরতে সহায়তা করবে।
প্রতিবন্ধী ভোটার সংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় অন্তত একটি কেন্দ্রকে প্রবেশগম্য করার উদ্যোগ নেওয়া যায়। যেখানে নিচতলায় ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা এবং পোর্টেবল র্যাম্পের ব্যবস্থা থাকবে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা যেন তাদের মনোনীত ব্যক্তির দ্বারাই ভোট দিতে পারেন, এ বিষয়ে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের সচেতন করতে হবে। প্রবেশগম্য ভোটকেন্দ্রের কর্মকর্তাদের ইশারা ভাষার প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
আমাদের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এ শুধু দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর ভোটদানের বিষয়টি উল্লেখ আছে। অল্প সময়ের মাঝে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন হয়তো সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্টদের মাঝে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভোটদান বিষয়ে ঐকমত্য তৈরি করতে পারে, যেন আইন তাতে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।
বাংলাদেশ জাতিসংঘের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সনদ ২০০৬ এবং জাতিসংঘের নাগরিক ও রাজনৈতিক কভেনেন্টে স্বাক্ষর ও অনুস্বাক্ষরকারী দেশ, যেখানে সব নাগরিকের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও ভোট দেওয়ার বিষয় উল্লেখ আছে। পাশাপাশি সরকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ পাস করেছে। সেই আইনের ১৬ অনুচ্ছেদে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভোটদানের বিষয়টি বলা আছে।
ভোটদান গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। ভোটদান প্রক্রিয়া যত অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণমূলক হবে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া তত শক্তিশালী হবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পাশাপাশি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্বাচ্ছন্দ্যে ভোট দেওয়া নিশ্চিত করা গেলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সমৃদ্ধ হবে। সমকাল।
তালুকদার রিফাত পাশা: পলিসি কর্মকর্তা, ইনস্টিটিউট অব ওয়েলবিং বাংলাদেশ