ডেঙ্গু আর কত প্রাণ নিলে কর্তৃপক্ষের হুঁশ ফিরবে?

ডেঙ্গু আমাদের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে একেবারে উদোম করে দিল। মশাবাহিত এ রোগের সামনে মানুষের এতটা অসহায়ত্ব এর আগে অন্য কোনো রোগে দেখা যায়নি। যেখানে এ ধরনের একটা মহামারি মোকাবিলায় কর্তৃপক্ষ এবং জনগণের মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি, সেখানে সব দায় নাগরিকদের ওপর চাপিয়ে জনস্বাস্থ্য দেখভালের কর্তৃপক্ষগুলো প্রায় হাত গুটিয়ে বসে আছে। ফলস্বরূপ, দুই বছর আগেও যে ডেঙ্গু শুধু রাজধানীতে সীমাবদ্ধ ছিল, তা এখন প্রায় সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। যথাযথ চিকিৎসা অবকাঠামো ও ব্যবস্থাপনার অভাবে মানুষ এক অর্থে বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে।
ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ছিল ৯৬৭; দ্রুতবেগে তা হাজারের ঘরের দিকে ধাবমান। প্রতিদিন অন্তত ১২-১৩ জনের মৃত্যু ঘটছে। দৈনিক মৃত্যুর এ সংখ্যা এমনকি কয়েকবার ২০ ছাড়িয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যাও আতঙ্কজাগানিয়া। বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত তা ছিল ১ লাখ ৯৯ হাজার ১৮৮। ইতোমধ্যে যে তা দুই লাখ ছাড়িয়ে গেছে, সন্দেহ নেই। কারণ প্রতিদিন দুই-তিন হাজার মানুষ ডেঙ্গুর চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।
এটা কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমন একটা হিসাব, যা নির্ধারিত হয় তাদের নির্বাচিত হাসপাতালগুলোত ডেঙ্গু রোগী ভর্তির ভিত্তিতে। সাধারণত ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা খরচ এবং নানা হয়রানি এড়াতে হাসপাতালে যান একেবারে না পারতে। তার ওপর প্রতিদিন বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে বহু ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হন; এদের হিসাব সরকারি পরিসংখ্যানে আসে না। অনেক রোগী আছেন, যারা উদাসীনতা কিংবা খরচ; যে কোনো কারণেই ডেঙ্গু পরীক্ষার ধারেকাছে যান না। ফলে তারাও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোজকার ব্রিফিংয়ে স্বাভাবিকভাবেই মিসিং থাকেন।
দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা দুই বছর আগের করোনা অতিমারিকালেও উন্মোচিত হয়েছিল। কিন্তু রোগটি ছিল একেবারেই আনকোরা; তদুপরি বিদেশ থেকে আসা। স্বাভাবিকভাবেই আতঙ্ক ছিল অনেক বেশি। অর্থনীতিসহ সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে হলেও, তাই তাকে ঠেকানোর চেষ্টা হয়। পরিস্থিতিটা এমন ছিল, যে কোনো উপায়ে করোনাকে থামানোর দিকেই ছিল সবার মনোযোগ। কখনও লকডাউন দিয়ে, কখনও মানুষের চলাচল সীমিত করে; সর্বোপরি টিকাসহ নানা চিকিৎসা সরঞ্জাম জোগাড় করে তাকে ঠেকানো হয়। সবার স্মরণে থাকার কথা, তখন প্রধান তাগিদ ছিল করোনা ভাইরাসজনিত কভিড-১৯ রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা দেশব্যাপী বিস্তৃত করা।
ঢাকায় তো বটেই; ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতেও যত বেশি সম্ভব নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র-আইসিইউ স্থাপন এবং অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করা নাগরিকদের দিক থেকে প্রধান দাবি ছিল। অর্থাৎ পরিস্থিতি কেন এ পর্যায়ে গেল, এতে কার কী দায় ইত্যাদি বিষয় খতিয়ে দেখার অবকাশ তখন কমই ছিল। ফলে একভাবে– জবাবদিহিহীনতার সুযোগে এক টাকার কাজের পেছনে একশ টাকা খরচ করে– চিকিৎসা অবকাঠামো গড়ে তোলার পাশাপাশি চিকিৎসা সরঞ্জাম জোগাড়যন্তরের কাজটি মোটামুটি হলেও তখন জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সতেজ করার কাজটি আদৌ হয়নি। যার পরিণামে বর্তমানে আমাদের ডেঙ্গুর তোপে চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে।
এ বছর ডেঙ্গুর কবলে পড়ে এখন পর্যন্ত যত মানুষ মারা গেছে, তার বেশির ভাগ নারী ও শিশু। পুরুষদের মধ্যে যাদের কো-মর্বিডিটি বা অন্য জটিল রোগ আছে, তারাও এর সহজ শিকারে পরিণত হচ্ছেন। ডেঙ্গুর কারণে বহু পরিবার একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে দিশেহারা বোধ করছে। এমন বহু পরিবার পাওয়া যাবে, যেখানে কচি শিশুদের অসহায় করে দিয়ে মা ডেঙ্গুতে গত হয়েছেন; এমনও পরিবার আছে যেখানে ডেঙ্গুর কারণে বাবা-মা পুরো সন্তানহীন হয়ে পড়েছেন।
আরও দুঃখজনক, সংবাদমাধ্যমে যখন এসব মাতৃহীন শিশু কিংবা মৃত শিশুর কচি মুখ দেখে অতি বড় পাষাণেরও বুকে তোলপাড় হয়, তখনও আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগ ও স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের– জনস্বাস্থ্য দেখভালের প্রধান দায়িত্ব যাদের, কোনো হেলদোল আছে বলে মনে হয় না।
অদ্ভুত বিষয়, আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা মনে করেন, জনস্বাস্থ্য মানে নিছক চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি সাধন। এ জন্য তারা বিশেষত গত দেড় দশকে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে একদিকে একের পর এক ভবন নির্মাণ করেছেন, অন্যদিকে দেদার বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি প্রয়োজন থাক বা না থাক, কিনেছেন। অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মানুষের চিকিৎসার বদলে গরুর খামার পরিচালনা করছেন, এমন খবরও ইদানীং সংবাদমাধ্যমে আসে। এ খবর তো বহুল আলোচিত; উপযুক্ত জায়গা এবং দক্ষ জনবলের অভাবে বহু জেলা হাসপাতালে জনগণের কষ্টার্জিত অর্থে কেনা আইসিইউ বেড স্থাপন করা যাচ্ছে না; সেগুলো স্টোরে পড়ে পড়ে অকেজো হচ্ছে।
অন্যদিকে ইউনিয়ন পরিষদ দূরের কথা; সিটি করপোরেশন, পৌরসভার মতো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানও জানে না মশা মারার বাইরে আর কী কী দায়িত্ব তাদের পালন করার কথা। এমনকি মশা মারার কাজও ঠিকমতো করতে পারে না। এই যে ডেঙ্গুর এতটা দাপট চলছে; ঢাকার দুই সিটি মেয়র জানেনই না কোনটা তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ– মশার লার্ভা মারা, না উড়ন্ত মশা মারা? সংবাদমাধ্যমে আমরা দেখছি তারা মাঝেমধ্যে নগরীর বিভিন্ন স্থানে লার্ভা খুঁজে বেড়াচ্ছেন; অন্যদিকে আগের মতোই ফগার মেশিন কাঁধে নিয়ে তাদের কর্মীরা উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তারা বলছেন, নাগরিকরা নিজ নিজ ঘরবাড়ি পরিষ্কার রাখছেন না। কিন্তু এ বিষয়ে জোরদার সচেতনতা অভিযানও কি দেখা যায়? কিছু ক্ষেত্রে নাগরিকদের বাধ্যও করতে হয় এবং সে দায়িত্ব সিটি করপোরেশন বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।
জনস্বাস্থ্য বিষয়ে আমাদের স্থানীয় সরকার বিভাগ কতটুকু উদাসীন তার আরেকটা উদাহরণ দেওয়া যাক। গত ২২ সেপ্টেম্বর সমকাল জানায়, ২০১৯ সালের ডেঙ্গুর চণ্ডরূপের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে মন্ত্রণালয় ২০২১ সালে ‘ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত অন্যান্য রোগ প্রতিরোধে জাতীয় নির্দেশিকা’ প্রস্তুত করে। ‘জানুয়ারি হতে ডিসেম্বর, মশক নিধন বছরভর’ স্লোগানসংবলিত ওই নির্দেশিকায় বলা আছে– ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কমিটি থাকবে। প্রতি বছর ডিসেম্বরের মধ্যে কমিটিগুলোর কাছ থেকে পরিকল্পনা নিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগ জানুয়ারির মধ্যে মাঠ পর্যায়ে চূড়ান্ত কর্মপরিকল্পনা পাঠাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মাঠ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা-জনপ্রতিধি জানেনই না এই নির্দেশিকার কথা। এমনকি স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবও স্বীকার করেছেন, জাতীয় নির্দেশিকাটি প্রণয়নের পর যতটা গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন ছিল, তা দেওয়া হয়নি।
আসলে জনস্বাস্থ্য বিষয়টাই সম্ভবত আমাদের নীতিনির্ধারকদের কাছে পরিষ্কার নয়। এখানে যে প্রতিকারের চেয়ে রোগ প্রতিরোধের বিষয়টি সমান গুরুত্বপূর্ণ, তা অন্তত তাদের কাজকর্ম দেখে বোঝা দুরূহ। এ কারণেই দৃশ্যদূষণ, শব্দদূষণ তো দূরস্থান, বায়ুদূষণ– যার শিকার হয়ে প্রতি বছর দেশে কয়েক হাজার মানুষ মারা যায় বলে একাধিক আন্তর্জাতিক জরিপে উঠে এসেছে, তা ঠেকাতেও তাদের কার্যকর কোনো তৎপরতা দেখা যায় না। এমনকি বিশুদ্ধ বা নিরাপদ পানি সরবরাহেও এদের উদাসীনতা প্রবাদপ্রতিম। সমস্যা হলো, নাগরিকদের দিক থেকেও এসব বিষয়ে জোরালো তাগিদ নেই। না কাঁদলে নাকি মা-ও দুধ দেয় না; ঘুমন্ত নাগরিকদের সুরক্ষা কবে কোন শাসক নিজে থেকে দিয়েছে? সমকাল।
সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল