বৃষ্টির ২৪ ঘণ্টা পরও অচেনা ঢাকা, পথে পথে দুর্ভোগ
অনলাইন ডেস্ক: মাত্র ছয় ঘণ্টার অতিপ্রবল বৃষ্টিতে রাজধানী হয়ে পড়ে অচল। রাস্তায় জলাবদ্ধতা ও যানজটের সঙ্গে যুদ্ধ চলে ভোর পর্যন্ত। পানিবন্দি মানুষের কেটেছে নির্ঘুম রাত।
দুর্ভোগের শেষে ছুটির দিনে ঘুম থেকে উঠেই নগরবাসী পেয়েছেন ঝলমলে রোদ। তবে যারা বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর ঘর থেকে বের হননি, তারা বুঝতেই পারেননি কী ঘটে গেছে রাজধানীতে।
তবে রাতের বৃষ্টিতে ঢাকা কতটা এলোমেলো হয়ে গেছে, তা ফুটে ওঠে সকালের আলোয়। বিভিন্ন মার্কেটে থইথই করছে পানি। রাজপথ থেকে অলিগলি– সর্বত্রই দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। কোথাও হাঁটু থেকে কোমড়পানি জমে।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর নিউমার্কেট, ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), আজিমপুর, মোহাম্মদপুর, গুলিস্তান, মিরপুর, মালিবাগ, শান্তিনগর, সায়েদাবাদ, শনির আখড়া, পুরান ঢাকা, বংশাল, নাজিমুদ্দিন রোড, গ্রিন রোডসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, রাতের জলাবদ্ধতা তখনও রয়ে গেছে। জলাবদ্ধতা নিরসনে কয়েকটি এলাকায় সিটি করপোরেশনের কুইক রেসপন্স টিমকে কাজ করতে দেখা গেলেও জনবল ছিল খুবই কম।
নিউমার্কেটে হাঁটুপানি, কেনাবেচা বন্ধ
ছুটির দিন হিসেবে শুক্রবারে রাজধানীর নিউমার্কেটে বিক্রিবাট্টা একটু বেশিই হয়। কারণ, সারা সপ্তাহে যাদের সময় হয় না, তারা শুক্রবার এই মার্কেটে গিয়ে কেনাকাটা সারেন। তবে গতকাল বিকেল ৩টায় নিউমার্কেট এলাকার চিত্র একেবারেই ভিন্ন। পুরো মার্কেট ও আশপাশ জলমগ্ন। অনেক দোকানিকে কাপড়সহ অন্যান্য জিনিসপত্র বাইরে বের করে শুকানোর চেষ্টা করতে দেখা যায়। অনেকে আবার সেচ দিয়ে দোকান থেকে পানি বের করেন। পানি জমে থাকার কারণে ক্রেতারা নিউমার্কেটের ভেতর ঢুকতে পারছিলেন না।
ঢাকা নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলাম বলেন, জলাবদ্ধতা হতে পারে। কিন্তু তাই বলে ১৫ থেকে ২০ ঘণ্টা পরও পানি নামবে না, এটা কেমন কথা? এই ব্যর্থতার জন্য যারা দায়ী, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। জলাবদ্ধতার কারণে কতটা ক্ষতি হয়েছে, তা পরে হিসাব করে জানা যাবে বলে জানান তিনি।
নিউমার্কেটের দোকানি নজরুল বলেন, রাতে সব মাল উঁচু করে রেখে গেছি। সকালে এসে দেখি পানি আরও বেড়েছে। দোকানের ক্যাশ বাক্সসহ প্রায় অর্ধেক কাপড় পানিতে ভিজে গেছে।
এদিকে, নিউমার্কেটের সামনের সড়ক পুরোটাই পানিতে ডুবে ছিল দুপুর পর্যন্ত। নীলক্ষেতের সামনের সড়কে পানি জমে থাকার কারণে তেমন কোনো গাড়ি চলাচল করেনি। তবে সাধারণ মানুষ রিকশা ও ভ্যানে করে ওই সড়ক পারাপার হন। নিউমার্কেটের উল্টো দিকে ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটে দু-একটি দোকান খোলা দেখা গেলেও সেখানে যাওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি নেই। ঢাকা কলেজের বিপরীত পাশের গাউছিয়া, ধানমন্ডি হকার্স ও বদরুদ্দোজা মার্কেটের বিক্রেতাদের দোকান থেকে পানি বের করতে দেখা গেছে। তাদের অনেক কাপড় ভিজে গেছে।
আগুনের পর পানিতে ডুবেছে কৃষি মার্কেট
গত ১৪ সেপ্টেম্বর ভোররাতে ভয়াবহ আগুনের পর এবার পানিতে ডুবে আরেকবার ক্ষতির মুখে পড়েছেন রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের ব্যবসায়ীরা। গতকাল দুপুরে মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটের চালের আড়তে গিয়ে দেখা যায়, পানিতে ভিজে যাওয়া চাল-ডালসহ বিভিন্ন পণ্যের বস্তা বের করছেন ব্যবসায়ীরা। কেউ কেউ জমে থাকা পানি সরাতে ব্যস্ত।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের একজন বিসমিল্লাহ ট্রেডিংয়ের মালিক শামসুজ্জামান বলেন, আমার দুই দোকানের প্রায় ৩০০ বস্তা চাল নষ্ট হয়েছে। যার আনুমানিক বাজারমূল্য ৯ লাখ টাকা।
বৃষ্টি হলেই মার্কেটে পানি ওঠার কারণ জানতে চাইলে এ ব্যবসায়ী বলেন, আমাদের পাশের রিং রোড উঁচু হয়ে যাওয়ায় সব দিকের পানি দ্রুত চলে আসে। কোনো দিকের পানি নামতে পারে না। একটু বেশি বৃষ্টি হলেই পানিতে ভেসে যায়।
চালের আড়তে পানি উঠে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ভিজে যাওয়ার খবরে পার্শ্ববর্তী এলাকার অনেকেই কম দামে চালসহ অন্যান্য পণ্য কিনতে আসেন। নবোদয় হাউজিং এলাকার বাসিন্দা সালমা আক্তার ১ হাজার ৫০০ টাকা দামের ২৫ কেজির দুই বস্তা চাল তিনি কিনেছেন ৫০০ টাকায়।
কৃষি মার্কেট চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মনিরুল ইসলাম মন্টু বলেন, বৃষ্টিতে আড়তের প্রতিটি দোকানে পানি ঢুকে প্রায় কয়েক কোটি টাকার চাল ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে।
জলাবদ্ধ ঢাবির কুয়েত মৈত্রী হল ও বুয়েট
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) কুয়েত মৈত্রী হলে পানি নিষ্কাশনের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় গতকাল বিকেলও নামেনি পানি। বৃহস্পতিবার রাত থেকেই ছিল না বিদ্যুৎ। এর ফলে গোসল ও খাওয়ার পানিরও সংকট দেখা দিয়েছে হলটিতে।
ওই হলের আবাসিক শিক্ষার্থী লিমা আক্তার অভিযোগ করে বলেন, আমাদের এমন জরুরি অবস্থাকে মাথায় রেখে কোনো পূর্বপ্রস্তুতি নেয়নি প্রশাসন। এই রাতে মেয়েগুলো তাদের জিনিসপত্রসহ কোথায় যাবে? সন্ধ্যা থেকে যখন পানি বাড়তে শুরু করে, তখনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
একই চিত্র দেখা যায় বুয়েটে। রাতের বৃষ্টি ক্যাম্পসের ক্যাফেটোরিয়াসহ বিভিন্ন হল পানিতে ভাসতে থাকে। তিতুমীর হলের নিচতলার প্রতিটি কক্ষ পানিতে ডুবে যায়। শেরেবাংলা হলেও একই চিত্র।
এ ছাড়া ঢাকা কলেজের আটটি ছাত্রাবাসের পাঁচ হাজারেরও বেশি আবাসিক শিক্ষার্থী পানিবন্দি হয়ে গতকাল বিকেল পর্যন্ত দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। রিজার্ভ পানির ট্যাঙ্কও ডুবে গেছে ময়লার পানিতে। ফলে নিরাপদ খাবার পানির সংকটও দেখা দিয়েছে।
পথে পথে ভোগান্তি
মার্কেট ছাড়াও রাজধানীর অলিগলি গতকাল বিকেলেও ছিল জলমগ্ন। আজিমপুরে দেখা গেছে গলি, দোকানপাট এবং বাসাবাড়ির নিচতলায়ও বাসিন্দারা পানি সরানোর চেষ্টা করছেন। মেয়র হানিফ উড়াল সড়ক থেকে নামার জায়গা থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনের অংশের সড়ক দুপুর ১২টা পর্যন্ত পানির নিচে ছিল। এদিকে ধানমন্ডির বায়তুত তাওয়াব আবাসিক এলাকার কিছু সড়কে সকাল ১১টার দিকেও পানি জমা দেখা গেছে। বসুন্ধরা শপিংমলের পেছনের সড়কে দুপুর ১টায়ও হাঁটুর ওপর পানি।
সোনালী/জেআর