বাদশার কণ্ঠস্বরে দৃশ্যমান বঙ্গবন্ধু রেলসেতু
উত্তরে বিনিয়োগ-শিল্পায়নের হাতছানি
♦ প্রকল্প ব্যয় ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা
♦ দৃশ্যমান ২ দশমিক ২১ কিলোমিটার
♦ ২৪ সালের শেষে চলবে ট্রেন
জগদীশ রবিদাস ও সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি: ১৯৯৮ সালে উত্তাল যমুনার বুক চিরে নির্মিত হয় বঙ্গবন্ধু সেতু। ওই বছরের ২৩ জুন যান চলাচলের জন্য সেতুটি উন্মুক্ত করা হলে প্রথমবারের মতো শুরু হয় ঢাকার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগ।
তবে এক দশক পেরিয়ে ২০০৮ সালে সেতুতে হঠাৎ ফাটল দেখা দিলে ট্রেনের গতি কমিয়ে আনা হয় মাত্র ২০ কিলোমিটারে। এতে ওই সেতুমুখী প্রায় ৩৮টি ট্রেন একদিকে যেমন সময় অপচয়ের কবলে পড়তে শুরু করে; অপরদিকে শিডিউলের চরম বিপর্যেয় কারণে দিনকে দিন ‘ফ্যাকাসে’ হতে শুরু করে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা।
নিষিদ্ধ হয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ের মালবাহী ট্রেন চলাচল। ফাটলের কারণে চাহিদা থাকার পরও ট্রেনের সংখ্যা আর বৃদ্ধি করতে পারেনি রেল কর্তৃপক্ষ। বলতে গেলে স্বাচ্ছন্দে ট্রেন চলাচলের জন্য এক প্রকার অযোগ্যই হয়ে পড়ে বঙ্গবন্ধু সেতু। এতে অনেকটাই মুখ থুবড়ে পড়ে উত্তরাঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য। বাড়তে শুরু করে যাত্রী ভোগান্তিও।
উত্তরে রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে এমন করুন পরিস্থিতিতে ফজলে হোসেন বাদশা নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজশাহী-২ (সদর) আসন থেকে নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১২ সালের ২০ জুন বাজেট বক্তৃতায় সংসদে বঙ্গবন্ধু সেতুর পাশে আরেকটি পৃথক রেলসেতু নির্মাণের প্রস্তাব করেন। জনস্বার্থে পৃথক রেলসেতুর নির্মাণের যৌক্তিকতা তুলে ধরে ওই বক্তৃতায় বাদশা বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সেতু রেল যোগাযোগের জন্য যথেষ্ট নয়। রেল যোগাযোগের জন্য বঙ্গবন্ধু সেতুর পাশে আরেকটি পৃথক রেল সেতু নির্মাণ করতে হবে। যাতে রেলের জন্য বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপরে চাপ না পরে।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদের সেদিনের অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন।
শুধু নবমই নয়, একাধারে দশম জাতীয় সংসদের ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতা এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতাসহ ২০১৭ সালের শেষের দিকে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়েও জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মাণের দাবিটি জোরালোভাবে উপস্থাপন করেন সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা। রাজশাহী তথা উত্তরাঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে তিনি একাধিকবার এ বিষয়টির ওপর প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন রেলমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
সংসদে বারংবার বাদশার এমন দাবির প্রেক্ষিতে এক পর্যায়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এ নিয়ে কার্যকর পর্যালোচনা শুরু করা হয়। রেল বিভাগের বিভিন্ন পর্যায়ের তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে সরকার এটিকে বৃহৎ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে। পরে এ সমস্যা সমাধানের জন্য অবশেষে যমুনা নদীর ওপর আলাদা একটি রেলসেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার।
সেতু সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রক্রিয়া সমাপ্তির পর ২০২০ সালের ২৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। চার দশমিক আট কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সেতুটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। জাপান ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সমান্তরাল ডুয়েল গেজ ডাবল ট্র্যাকের এই রেলসেতুর নির্মাণে ২০২১ সালের মার্চে সেতুর পিলার নির্মাণে পাইলিংয়ের কাজ শুরু হয়।
বর্তমানে যমুনার বুকে নির্মিত হচ্ছে দেশের মেগা প্রকল্পের অন্যতম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলসেতু। এই কর্মযজ্ঞকে ঘিরে সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইলে নদীর দুই পাড়ে দুটি প্যাকেজে দেশি-বিদেশি প্রকৌশলী আর কর্মীদের তত্ত্বাবধানে নতুন দিগন্ত সৃষ্টির লক্ষ্যে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে কর্মযজ্ঞ। প্রকল্প কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মূল সেতুর ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটারের মধ্যে উত্তাল যমুনার বুকে এখন দৃশ্যমান প্রায় ২ দশমিক ২১ কিলোমিটার। যথাসময়ে কাজ শেষ করা গেলে ২০২৪ সালে এ সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হবে। তখন ঢাকার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলের রেল যোগাযোগে মানুষের যাতায়াত এবং পণ্য পরিবহনে আরও গতি আসবে।
গতকাল বুধবার প্রকল্পের একটি সূত্র জানায়, জাপান ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে ডব্লিউ ডি-১ ও ডব্লিউ ডি-২ নামে দুটি প্যাকেজে জাপানি ৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছেন। ডব্লিউ ডি-১ প্যাকেজটি বাস্তবায়ন করছে জাপানি আন্তর্জাতিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওবাইসি, টোআ করপোরেশন ও জেইসি (ওটিজে) জয়েন্ট ভেঞ্চার।
টাঙ্গাইলের প্রান্তে সেতুর ২৪ থেকে ৫০ নম্বর পিয়ার পর্যন্ত কাজ করছে তারা। ডব্লিউ ডি-২ প্যাকেজটি বাস্তবায়নে রয়েছে জাপানের আইএইচআই ও এসএমসিসি জয়েন্ট ভেঞ্চার। সিরাজগঞ্জের প্রান্তে ১ থেকে ২৩ নম্বর পিলার পর্যন্ত সেতুর নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করছে তারা। সেতুটি নির্মাণে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, নেপাল ও বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কর্মী নিয়োজিত রয়েছেন। দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন তারা।
এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলসেতু প্রকল্পের সাব স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার রবিউল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, এ সেতুতে ৫০টি পিলার, দুটি পিলারের মাঝখানে একটি করে অর্থাৎ ৪৯টি স্প্যান বসানো হবে। প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য ১০০ মিটার। এ পর্যন্ত স্প্যান বসানো হয়েছে ২২টি। এরই মধ্যে ৩১টি পিলার বসানো শেষ হয়েছে। বাকি ১৯টি পিলার বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে।
প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী তানভীরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ইতিমধ্যে ডাব্লিউডি-১ প্যাকেজের ৭৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং ডাব্লিউডি-২ প্যাকেজের ৫৯ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। সেতুর প্রায় দুই দশমিক ২১ কিলোমিটার দৃশ্যমান হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে সাত হাজার ৩৬০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিক কাজ করছে। এর মধ্যে কনসালটেন্ট রয়েছেন ১২০ জন। ডাব্লিউডি-১ প্যাকেজে ৮৫০ জন স্টাফ ও দুই হাজার ২০০ জন শ্রমিক এবং ডাব্লিউডি-২ প্যাকেজে এক হাজার ৮৫০ জন স্টাফ এবং দুই হাজার ৩৪০ জন শ্রমিক কাজ করছে। নির্ধারিত সময়েই এ সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার গণমাধ্যমকে বলেন, যে মাল গাড়িগুলো এখন সেতুর আগে থামানো হয়, সেতুটি নির্মাণ হওয়ার পরে আর থামানো হবে না। সেটি যথাসময়ে নিজস্ব গন্তব্যে আনলোডিং হবে। এই সেতুর কারণে এ অঞ্চলে যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করেন বা শিল্প উদ্যোক্তা রয়েছেন, তাদের সুবিধা অনেকাংশে বেড়ে যাবে। তাদেরই নয়, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষসহ সাধারণ জনগণের সুবিধাও অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে। এটি বাস্তবায়িত হয়ে যাওয়ার পর উত্তরাঞ্চলের উন্নয়নে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হবে।
এ নিয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী-২ আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, রাজশাহী তথা উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ ও উন্নত না হলে এ অঞ্চলে শিল্প প্রতিষ্ঠা ও বিনিয়োগের সম্ভাবনা কম। শুধুমাত্র সড়কের ওপর নির্ভরশীল হয়ে কার্যকর যোগাযোগ ব্যবস্থা ও শিল্পায়ন গড়ে উঠতে পারে না। এক্ষেত্রে রেলের উন্নতি দরকার। আর বর্তমানে রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যাপ্ত নয়।
টানা তিনবারের এই সংসদ সদস্য বলেন, সেতুতে ফাটলের কারণে উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা তরাম্বিত হতে পারছে না। অতএব, সবদিক বিবেচনায় সংসদে আমরা বঙ্গবন্ধু সেতুর পাশে আরেকটি পৃথক রেলসেতু নির্মাণের দাবি তুলেছিলাম। আমি বারংবার মহান সংসদে দাবি তুলেছি, বর্তমান সময়ে পৃথক রেলসেতু নির্মাণের কোন বিকল্প নেই। আমি আনন্দিত, বর্তমান সরকার এটিকে আমলে নিয়েছে এবং বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াও অনেকটাই দৃশ্যমান। এর জন্য রাজশাহীবাসীর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাই। বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলসেতু পুরোপুরি নির্মাণ হয়ে গেলে একদিকে যেমন রেলপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটবে, অপরদিকে উত্তরাঞ্চলে শিল্প বাণিজ্য তথা বিনিয়োগেরও নতুন দার উন্মোচিত হবে।
সোনালী/জেআর