ঢাকা | সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৪ - ১:২২ পূর্বাহ্ন

আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে ১২ দাবি

  • আপডেট: Wednesday, August 9, 2023 - 9:00 pm

কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে রঙিন আয়োজন

অনলাইন  ডেস্ক: আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানসহ ১২দফা দাবি জানিয়ে আন্তর্জাতিক আদিবাদী দিবস উদযাপন করেছে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম।

দিবসটি উপলক্ষে বুধবার ঢাকার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে বর্ণাঢ্য নানা কর্মসূচি ও রঙিন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠান থেকে ১২দফা দাবি তুলে ধরেছেন আদিবাসী নেতারা। অনুষ্ঠান সভাপতিত্ব করেন আদিবাসী নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন। অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন অধ্যাপক রুবাইয়াৎ ফেরদৌস।

আদিবাসী যুবসমাজকে নীতি-আদর্শ সমুন্নত রেখে আরও বেশি সংগ্রামী এবং সংঘবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে অনুষ্ঠানে সন্তু লারমা বলেন, আদিবাসী দিবসে তারুণ্যের শক্তিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এই কথা বলতে চাই, যুগে যুগে সকল সংগ্রামে যারা নেতৃত্ব দিয়েছে তারা হচ্ছে যুবসমাজ। এই যুবসমাজের উদ্দেশ্যে বলব, সবাই মিলে আসুন, আরও অধিকতরভাবে সংগঠিত হই, অধিকতরভাবে সংগ্রামী হয়ে উঠি। সংগঠিত হতে হলে যুক্ত থাকতে হবে নীতি-আদর্শ। সেই নীতি আদর্শ, সর্বোচ্চ ত্যাগ করতে হলেও দ্বিধাহীনভাবে থাকবে সংকল্পবদ্ধ।

লড়াইয়ে তরুণরা এখনো আদর্শিকভাবে ঐক্যবদ্ধ নয় জানিয়ে সন্তু লারমা বলেন, এই লড়াই-সংগ্রামে যে নির্দিষ্ট লক্ষ্য, তা আমরা নির্ধারণ করতে পারিনি। আমি মনে করি, তার পেছনে যে কারণ- তা হল, আদিবাসী যুবসমাজের মধ্যে সুনির্দিষ্ট প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। নেতৃত্বের মধ্যে একটা অব্যাহত সংগ্রাম ধরে রেখে দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামে নিজের বিশ্বাস রেখেই লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হয়। আমাদের আদিবাসী যুবসমাজ সেই লড়াই-সংগ্রামে এখনো সেভাবে যুক্ত হতে পারেনি। এই দেশের বাস্তবতাকে প্রাধান্য দিয়ে যুবসমাজকে আরও বেশি সংগ্রামী হতে হবে, সংঘবদ্ধ হতে হবে। নীতি-আদর্শকে সমুন্নত রেখে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

১৯৯৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘ প্রতি বছর ৯ অগাস্ট আদিবাসী দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়। জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র, বিভিন্ন সংস্থা, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সবাই যেন আদিবাসীদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হন, আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন, সেটাই এ দিবস পালনের লক্ষ্য। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ঠিক হয়েছে “আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আদিবাসী তরুণরাই মূল শক্তি।” জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস দিবসটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন। শহীদ মিনারের অনুষ্ঠানে সেই বাণীর বাংলায় অনুবাদ পড়ে শোনানো হয়।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জিব দ্রং বলেন, অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় বাংলাদেশের ৪০ লক্ষাধিক আদিবাসী জনগণ এখন এক কঠিন সংকট ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত ও প্রথাগত ভূমি থেকে ক্রমাগত তারা উচ্ছেদের মুখোমুখি হচ্ছে। ভূমি, বন ও প্রাকৃতিক সম্পদের চিরায়ত অধিকার থেকে আদিবাসীরা বঞ্চিত হচ্ছে। আদিবাসীদের আত্ম-পরিচয় ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার হল মানবাধিকার। কঠিন সংকটের মধ্যেও দেশের আদিবাসী জনগণ অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অবিচল আছে। আদিবাসী তরুণ সমাজ নব চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সক্রিয় আন্দোলনে অধিকতর এগিয়ে আসছে। আদিবাসী দিবসে আমরা দেশের গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে আদিবাসীদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাই।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাশেদ খান মেনন বলেন, বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর মাঝে যে বৈচিত্র্য রয়েছে, সেই বৈচিত্র্যই আমাদের ঐক্যের ভিত্তি। এই দেশে অধিকার প্রতিষ্ঠার যে লড়াই হয়েছে, সেখানে বাঙালিদের পাশাপাশি বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষও যুক্ত থেকেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

অধ্যাপক রুবাইয়াৎ ফেরদৌস বলেন, সেটি সভ্য রাষ্ট্র নয়, যে রাষ্ট্র তার নাগরিকদের অধিকারের মর্যাদা দেয় না। যে বাঙালি পাকিস্তানের ভাষাগত নিপীড়নের শিকার হয়েছে, জাতিগত নিপীড়নের শিকার হয়েছে, সামরিক নিপীড়নের শিকার হয়েছে, সেই বাংলাদেশই যখন স্বাধীন হল, তারা আবার আদিবাসীদের উপর একই নিপীড়ন করছে, এটা খুবই দুঃখজনক।

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের সভাপতি ফজলে হোসেন বাদশা এমপি বলেন, আমাদের যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন, তারা একটা বিভ্রান্তির মধ্যে আছেন। তারা চুক্তি করেন, বাস্তবায়ন করেন না। সমতল এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা একই কাতারে দাঁড়িয়েছেন। সমতলের আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন করা দরকার।

অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বলেন, এই সমাবেশে যে তরুণরা দাঁড়িয়েছেন, তারা এক আদর্শ বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে দাঁড়িয়েছেন, যে বাংলাদেশে সবার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। যে লড়াই করে পার্বত্য শান্তি চুক্তি করা হয়েছিল, এখন আরো বেশি লড়াই করে সেই চুক্তির বাস্তবায়ন করতে হবে। একা একা সমাজ বদলানো যায় না, সমাজকে সঠিক পথে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সম্মিলিত হতে হবে।

সাদেকা হালিম বলেন, আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস আগে যেভাবে বিভিন্ন জেলায় পালন করা হত, এখন কিন্তু সেভাবে হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না? কেউ কেউ হয়তো ভাবেন এখানে সরকারবিরোধী কথা হয়। কিন্তু সরকারকে সাথে নিয়েই তো দিবসটি আরও বড় পরিসরে পালন করা যায়।

অনুষ্ঠানে বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড নিয়ে সারা দেশের আদিবাসী সংগঠনের নেতারা অংশ নেন। তাদের মধ্যে ছিল- হাজং স্টুডেন্ট কাউন্সিল (হাসুক), আদিবাসী ইউনিয়ন, আদিবাসী ছাত্র সংগঠন, ওরাওঁ বাংলাদেশ সংস্কৃতি ফোরাম, খাসি, স্টুডেন্ট ইউনিয়ন, গারো স্টুডেন্ট ফেডারেশন, গারো ছাত্র সংগঠন, তঞ্চঙ্গ্যা স্টুডেন্টস ফোরাম, খুমী স্টুডেন্টের মত বিবিন্ন সংগঠন। সবশেষে সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশ নেন বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীর শিল্পীরা। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর হাজারো মানুষের অংশগ্রহণে হয় শোভাযাত্রা।

আদিবাসী নেতারা যে ১২টি দাবি উত্থাপনি করেছেন সেগুলো হলো- ১. আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারসহ আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। ২. আদিবাসীদের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ভূমির অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ৩. আদিবাসী তরুণ সমাজের নেতৃত্ব বিকাশ, প্রশিক্ষণ, শিক্ষা, উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ৪. আদিবাসী প্রশ্নে অন্যান্য দেশের মত সরকার, জাতিসংঘ ও আদিবাসী জনগণ এই ত্রিপক্ষীয় সংলাপের জন্য উৎসাহ ও প্রণোদনা দিতে হবে। ৫. পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। এ লক্ষ্যে সময়সূচি ভিত্তিক রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। ৬. সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে। ৭. আদিবাসীদের ভূমিতে তাদের স্বাধীন সম্মতি ছাড়া ইকোপার্ক, সামাজিক বনায়ন, ট্যুরিজম, ইপিজেড বা অন্য কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা চলবে না। ৮. আদিবাসীদের ওপর সকল নিপীড়ন, নির্যাতন ও হয়রানি বন্ধ করাসহ সকল মিথ্যা মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে। ৯. জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ২০০৭ সালে গৃহীত আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্র ও আইএলও ১৬৯ নম্বর কনভেনশন অনুসমর্থন ও আইএলও কনভেনশন ১০৭ বাস্তবায়ন করতে হবে। ১০. জাতীয় সংসদে আদিবাসীদের জন্য বিশেষ কোটা সংরক্ষণ বা আসন বরাদ্দ রাখতে হবে। ১১. প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরিতে আগের মত আদিবাসী কোটা সংরক্ষণ করতে হবে এবং অন্যান্য চাকরিসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি কোটা যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। ১২. রাষ্ট্রীয়ভাবে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উদযাপন করতে হবে।

সোনালী/জগদীশ রবিদাস