বাংলাদেশে এসে যে বার্তা দিলেন মার্কিন প্রতিনিধিরা
অনলাইন ডেস্ক: ঢাকা সফর করে যাওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার-সেক্রেটারি উজরা জেয়া ও অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু বহুমুখী বার্তা দিয়েছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতি, শ্রম ও মানবাধিকার এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের মতামত আরেক দফায় পরিষ্কার করে গেছেন ঢাকার কর্মকর্তাদের কাছে।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কী ভূমিকা নেয়, সেদিকেই আগ্রহ বেশি ছিল দেশের রাজনৈতিক মহলের। আগামী নির্বাচন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র যে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পাশাপাশি সংঘাতমুক্ত পরিবেশের ওপর বেশি জোর দিচ্ছে, সে বার্তাই পাওয়া গেছে জেয়া-লুর প্রতিটি বৈঠকে।
ভারত সফর করে মঙ্গলবার ঢাকা এসে পৌঁছানো যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও বেসামরিক নিরাপত্তা বিষয়ক আন্ডার-সেক্রেটারি উজরা জেয়া বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ওয়াশিংটনের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছেন। তার সঙ্গে প্রতিনিধি দলে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক অ্যাস্টিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু গতকাল সকালে কাঠমান্ডুর উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন।
এর আগে তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনসহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা ছাড়াও শ্রমিক আন্দোলন-কর্মী, নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দ এবং মানবাধিকার রক্ষাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
ঢাকা ও ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানান, উজরা জেয়া ও ডোনাল্ড লুর সঙ্গে সরকারপ্রধানসহ অন্য সবার সঙ্গে আলোচনায় নির্বাচন প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। প্রতিটিতেই সরকারের পক্ষ থেকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এজন্য কর্মপরিকল্পনাও ব্যাখ্যা করেছে সরকার। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও আইনি সুরক্ষার আওতায় কীভাবে হবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সে কথাও জানিয়েছেন সরকারের মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকেও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। এসব প্রতিশ্রুতির প্রতি আস্থা রেখে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র অব্যাহত সহযোগিতা করে যাবে বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রতিনিধিরা।
এ ক্ষেত্রে তাদের নতুন ভিসানীতি সহযোগিতা করবে বলেও মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা। পাশাপাশি মার্কিন পক্ষ থেকে সংঘাতমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে বারবার। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের বক্তব্যে বুধবার বাংলাদেশের দুই দলের পাশাপাশি বড় দুই সমাবেশ সংঘাতমুক্ত পরিবেশে হওয়ার প্রশংসা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, আমাদের প্রত্যাশিত পরিবেশের এটা শুরুমাত্র। সামনের দিনগুলোয়ও এমন নিরাপদ পরিবেশ বজায় রাখার প্রত্যাশার কথা বলা হয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকেও সংঘাতমুক্ত পরিবেশেই নির্বাচনের জন্য সম্ভব সব ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সর্বশেষ পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন প্রসঙ্গও আলোচনায় উঠেছে। সেখানে ভোট গ্রহণের আগে বড় ধরনের সংঘাত ও বিশালসংখ্যক মৃত্যু এড়ানো সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশে এমন পরিস্থিতি যেন না হয় সে বিষয়ে সেজন্য সবার সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে।
সূত্র জানান, জেয়া-লু ঢাকার কোনো বৈঠকেই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন শব্দের প্রয়োগ করেননি। মার্কিন কর্মকর্তাদের সফরে নির্বাচন ইস্যুতে এটা একটি নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা বলে মনে করেন ঢাকার কর্মকর্তারা। তবে উজরা জেয়া বৃহৎ জনগোষ্ঠীর নির্বাচনের সম্পৃক্ত থাকার কথা বলেছেন। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপের বিষয়েও নিজেদের থেকে কোনো কথা বলেননি মার্কিন প্রতিনিধিরা।
গণমাধ্যমের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, সংলাপ সবাই চায়, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সংলাপের বিষয়ে সরাসরি সম্পৃক্ত হবে না। ঢাকার এক কূটনীতিকের মতে, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা না বলা ও সংলাপে সম্পৃক্ত না থাকার কথা বলার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত দলগুলোর নিজেদের ওপরই বলে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে।
দেশের রাজনীতিতে সম্প্রতি আলোচিত নির্বাচনকালীন সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে কোথাও কোনো বক্তব্য না দেওয়াকেও যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান বলে মনে করেন ঢাকার ওই কূটনীতিক। সূত্রমতে, সফরে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল রোহিঙ্গা ইস্যুতেও বার্তা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা।
এ ক্ষেত্রে মার্কিন প্রতিনিধিদের বক্তব্য, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের পরিবেশ এখনো উপযুক্ত নয় এবং রোহিঙ্গাদের জীবিকা অর্জনের জন্য কাজের সুযোগ দেওয়ার যে দাবি ইদানীং পশ্চিমারা উত্থাপন করছে সেটাও উত্থাপন করেছেন জেয়া-লু। পাশাপাশি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও সহায়তায় আগের মতোই পাশে থাকার কথা বলেছেন তারা। নতুন করে ৭৪০ কোটি টাকা সহায়তার কথাও জানিয়েছেন।
বৈঠক সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, উজরা জেয়া ও ডোনাল্ড লুর সফরে শ্রম অধিকার ইস্যুতে শ্রমিকনেতা শহিদুল হত্যার বিষয়েও আলোচনায় এসেছে। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিচারের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, বিচারহীনতার সংস্কৃতি আর নেই। তাদের সফরের পর গতকাল শহিদুল হত্যার সঙ্গে জড়িত একজনকে কক্সবাজার থেকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।
এর পাশাপাশি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংস্কার ও সাংবাদিকদের ভীতিমুক্ত কাজের পরিবেশ নিশ্চিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে গেছেন উজরা জেয়া।
কূটনীতিকরা বলছেন, জেয়া-লুর সফরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ বছরের সম্পর্ককে যুক্তরাষ্ট্র যে গুরুত্ব দেয় সেই বার্তা। দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও বহুপক্ষীয় সব ক্ষেত্রেই তার স্বীকৃতি পাওয়া গেছে মার্কিন আন্ডার-সেক্রেটারির সফরে।
শান্তিপূর্ণ-স্থিতিশীল বাংলাদেশ তৈরিতে অভ্যন্তরীণ কাঠামো ও প্রতিষ্ঠান তৈরি এবং শক্তিশালী করতে তাদের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণের প্রত্যাশার কথাও জানিয়ে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দুই কর্মকর্তা।
যা বলল মার্কিন দূতাবাস: বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারির প্রতি অব্যাহত সমর্থন জানাতে উজরা জেয়া, ডোনাল্ড লুসহ ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করেছেন বলে জানিয়েছে মার্কিন দূতাবাস। জেয়া ও লুর ঢাকা ত্যাগের পর গতকাল ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে জানানো হয়েছে, সফরে বৈঠকগুলোয় আন্ডার-সেক্রেটারি জেয়া বাংলাদেশের অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্য অর্জনে একসঙ্গে কাজ করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
পাশাপাশি নাগরিক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, মানবাধিকার রক্ষাকর্মী, সাংবাদিক ও শ্রমিক আন্দোলন কর্মীদের নিরাপত্তার গুরুত্ব; মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য জবাবদিহিতা থাকা এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সমর্থন অব্যাহত রাখার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় মিয়ানমার এবং বাংলাদেশের উদ্যোগগুলোর সমর্থনে আরও ৭৪০ কোটি টাকার বেশি অনুদানের ঘোষণা করেছেন, যার মধ্যে প্রায় ৬১০ কোটি টাকা মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী ও তাদের আশ্রয়দানকারী জনগোষ্ঠী ও অন্যদের সহায়তার জন্য দেওয়া হবে।
এ ছাড়া আন্ডার-সেক্রেটারি জেয়া ফ্রিডম ফান্ড ও এর অংশীদারদের জন্য ১০ কোটি টাকারও বেশি অনুদান ঘোষণা করেন। এ টাকা মানব পাচারকারীদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া ৫০০-এর বেশি শিশুকে সমাজে পুনরেকত্রীকরণে ব্যবহার করা হবে।
আন্ডার-সেক্রেটারি জেয়া বলেছেন, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের সমৃদ্ধি ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমাদের লক্ষ্যপূরণে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার এবং গণতন্ত্র সমুন্নত রাখা ও মানবাধিকারের প্রতি সম্মান বজায় রেখে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
সোনালী/জেআর