বাজেট পাস হচ্ছে আজ
অনলাইন ডেস্ক: উচ্চ মূল্যস্ফীতির কথা বিবেচনায় নিয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মূল বেতনের ৫ শতাংশ প্রণোদনার ঘোষণা করা হয়েছে।
একই সঙ্গে টিআইএনধারীদের বাধ্যতামূলকভাবে ন্যূনতম ২০০০ টাকা করের প্রস্তাব প্রত্যাহারসহ আরও কয়েকটি সংশোধনী এনে জাতীয় সংসদে অর্থবিল ২০২৩ কণ্ঠভোটে পাস করা হয়েছে। গতকাল সংসদে এ বিল পাস করা হয়। আজ নতুন অর্থবছর ২০২৩-২৪-এর বাজেট পাস করা হবে।
এ বাজেট ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে। গতকাল জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর বক্তব্য দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেতন বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনার জন্য অর্থমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ জানান। তিনি আশা করেন, অর্থমন্ত্রী বিষয়টি গ্রহণ করবেন। পরে তা গৃহীত হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘সরকারি কর্মচারী যারা আছেন, তাদের বিশেষ বেতন হিসেবে মূল বেতনের ৫ শতাংশ এই আপৎকালীন সময়ে প্রদানের বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ জানাচ্ছি। মাননীয় অর্থমন্ত্রী আশা করি এ বিষয়টি গ্রহণ করবেন। আমরা ৫ শতাংশ মূল বেতন বিশেষ প্রণোদনা হিসেবে তাদের দেব।
এদিকে ব্যাপক সমালোচনা ও তীব্র বিরোধিতার মুখে টিআইএন থাকলেই রিটার্ন দাখিল করতে হবে এবং ন্যূনতম ২ হাজার টাকা কর দিতে হবে এমন প্রস্তাব বাতিল করে জাতীয় সংসদে পাস করা হয়েছে আয়কর আইন।
এবার বিষয়টি প্রস্তাবিত ২০২৩-২৪ বাজেটের (অর্থবিল-২০২৪) থেকেও প্রত্যাহার করা হয়েছে। সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হতে পারে- বিশেষজ্ঞদের এমন দাবি ও জনপ্রতিনিধিদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই এটা প্রত্যাহার করা হয়েছে। আজ ২৬ জুন প্রস্তাবিত এই বাজেট পাস করা হবে।
অন্যদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বল পয়েন্ট কলমের ওপর ১৫ শতাংশ মূল্যসংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। এই প্রস্তাবের বিষয়েও অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
ফলে এই সিদ্ধান্ত থেকেও সম্পূর্ণ সরে এসে এখানে আংশিক পরিবর্তন আনা হয়েছে। বল পয়েন্ট কলমের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হলেও এখন তা কমিয়ে পাঁচ শতাংশে নামিয়ে আনা হেেয়ছে। সূত্র জানায়, মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্নআয়ের মানুষের কথা চিন্তা করে প্রধানমন্ত্রী ন্যূনতম কর আরোপের বিধান বিলোপের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।
এনবিআর সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চূড়ান্ত বাজেটে সেই প্রভিশনটি বাতিল করবে। অর্থাৎ সরকারি-বেসরকারি সেবা পেতে কারও রিটার্ন জমার স্লিপ প্রয়োজন হলে আগের নিয়মে শূন্য আয় দেখিয়ে রিটার্ন জমা দেওয়া যাবে। বাজেটের ওপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সমাপনী বক্তব্যের পর অর্থবিল-২০২৩ সংসদে পাসের জন্য উত্থাপন করা হয়।
এর আগে বিলটির পর সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী, ফখরুল ইমাম, মুজিবুল হক, রুস্তম আলী ফরাজী, রওশন আরা মান্নান, কাজী ফিরোজ রশীদ, রেজাউল করিম, শহীদুজ্জামান সরকার প্রমুখ বক্তব্য দেন।
এ সময় তারা ব্যাংক খাতের অরাজকতা, কালো টাকা সাদা করা, অর্থ পাচার, আর্থিক খাতের নৈরাজ্য নিয়ে বক্তব্য দেন। অর্থবিল-২০২৩ এর ওপর এই সংসদ সদস্যদের আনা জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাবগুলো কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়।
গত ১ জুলাই ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেটে ঘাটতিই ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। যা মোট জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশেরও বেশি। অর্থবছর শেষে এই ঘাটতি আরও কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়েও নানা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা।
এদিকে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত এই বাজেটের মূল আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের মূল আকার ধরা হয় ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। অবশ্য সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ লাখ ৬০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। গতকাল জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এ বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য পরিস্থিতির উন্নয়ন ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা ফেরানোকেই প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন।
এদিকে দেশের অর্থনীতি এমনিতেই নানামুখী চাপে রয়েছে। ডলারের সংকট এখনো প্রকট।
‘উন্নয়নের অভিযাত্রার দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা’ শীর্ষক বাজেট বক্তৃতায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, জাতীয় নির্বাচনের বছরে অর্থনৈতিক কার্যক্রম চাঙা করতে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমের বিশাল বর্ণনা তুলে ধরেছেন অর্থমন্ত্রী। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কথা তুলে ধরেন তিনি। এবারই প্রথম অডিও ভিজুয়ালের মাধ্যমে বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী।
প্রস্তাবিত বাজেটে মোট আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের আয়ের লক্ষ্য ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা (অনুদান ছাড়া)। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। নানা সংকট সত্ত্বেও উচ্চতর জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে বলে আশা করছে সরকার।
এ জন্য আগামী অর্থবছরের জন্য ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপির লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। অন্যদিকে নিত্যপণ্যের বাজার লাগামহীনভাবে চললেও মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে ধরে রাখা লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। অথচ এপ্রিল শেষে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘর ছুঁই ছুঁই করছে।
তবে দীর্ঘ বিরতির পর এবার করমুক্ত আয়সীমা কিছুটা বাড়িয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা খাত নিয়ে ঢাকঢোল পেটানো হলেও এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে খুবই সামান্য। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য পরিস্থিতির উন্নয়ন ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা ফেরানোকেই প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন।
বিশাল আকার ঘাটতি অর্থায়নে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
সমাপনী বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমাদের আশপাশের অনেক দেশের তুলনায় আমরা ভালো আছি। আমাদের অর্থনীতি ভালো আছে। আপনারা আমাদের বৈদেশিক ঋণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তাদের জন্য বলি-আমাদের বর্তমান বৈদেশিক ঋণ জিডিপির মাত্র ৩৪ শতাংশ। এটা অন্য দেশের ২৬১ শতাংশ পর্যন্ত রয়েছে। ফলে বিদেশি ঋণের ক্ষেত্রে আমাদের কোনো ঝুঁকি নেই। আমরা ভালো অবস্থানে আছি।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন অর্থনীতির কারিগর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি আমাদের বাংলাদেশকে মাত্র ১৪ বছরে ৬০তম অবস্থান থেকে ৩৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশে পরিণত করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। এখন আমাদের লক্ষ্য ২০৪১ সালের মধ্যে বিশ্বের ২০টি বৃহৎ অর্থনীতির দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে একটি সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও জ্ঞান-ভিত্তিক স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা।
সোনালী/জেআর