সিটি নির্বাচন || প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে প্রতিনিধিত্বের লড়াই
জগদীশ রবিদাস: সচরাচর চলার পথে তৃতীয় লিঙ্গের কাউকে দেখলে অনেকেই আমরা আঁতকে উঠি। কেউ ভয় পাই। কেউবা আবার বিরক্তি প্রকাশ করি! প্রতিনিয়ত এসবের সম্মুখীন হওয়াটা স্বাভাবিক দৈনন্দিন জীবনে ঠিক কি পরিমাণ প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে; তা আমাদের উপলব্ধি করার কথা।
আমরা এটিকে ‘উপলব্ধির’ মাঝে সীমাবদ্ধ রাখলেও ওদের কিন্তু এসব বয়েই বেড়াতে হয়! এতে কেউ টিকে যান, কেউ ছিটকে পড়েন। কিন্তু সংগ্রামী সাগরিকা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন! ঘুরেই শুধু দাঁড়াননি; জন্মগত পাওয়া প্রতিবন্ধকতাকে নিয়ে গেছেন প্রতিনিধিত্বের দিকে। হ্যাঁ, তিনি এখন প্রার্থী! জয় পেলে নেতৃত্ব দেবেন আমাদের-আপনাদের।
রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক) নির্বাচনে ১৯, ২০ ও ২১ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তৃতীয় লিঙ্গের সুলতানা আহমেদ (সাগরিকা)। তার বাড়ি শহরের শাহমখদুম থানা এলাকার শিল্পীপাড়ায়। মা-বাবার চার সন্তানের একজন তিনি। বাবা নেই। বর্তমানে মা-বোন একসঙ্গে থাকেন। মাঝেমধ্যে তিনি বাড়িতে যান। তবে মায়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব তার কাঁধেই।
সামাজিক বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মধ্যেই অষ্টম শ্রেণি পাশ করেছেন সাগরিকা। তৃতীয় লিঙ্গের হওয়ায় এর ওপরে উঠা আর সম্ভব হয়নি! প্রতিবন্ধকতা নামক বোঝা সমাজ পেরিয়ে যখন পরিবার অবধি বিকশিত হয়; তখন বাড়িও ছাড়তে হয় তাকে। পরবর্তীতে কাঁটা পথে হেটেই কেটেছে তার জীবন। তবে এখন সব বাধা পেরিয়ে জনগণের সেবক হতে চান তিনি। নেমেছেন ভোটের লড়াইয়ে।
সিটি নির্বাচনের প্রতীক বরাদ্দ হয় গত ২ জুন। এরপর থেকেই প্রচারণায় ব্যস্ত সাগরিকা। তার মার্কা আনারস। নির্দিষ্ট এলাকায় ভোট করলেও তাকে নিয়ে আলোচনা পুরো নগরজুড়েই। ‘কিছু’ মানুষ নেগেটিভ মন্তব্য করলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই তার ভোটের লড়াইকে স্বাগত-সমর্থন জানাচ্ছেন। উৎসাহ দিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তাকে নিয়ে পোস্ট করছেন অনেকে। এতে প্রতিনিয়তই যেন লড়াইয়ের শক্তি সঞ্চয় করছেন সুলতানা ওরফে সাগরিকা।
নির্বাচনকে ঘিরে ১৯, ২০ ও ২১ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিনই গণসংযোগ করতে দেখা যাচ্ছে সাগরিকাকে। সাধারণ মানুষ যেন নিজে থেকেই কাজ করছে তার হয়ে। যেখানেই তিনি যাচ্ছেন; সেখানেই মানুষ ভিড় জমাচ্ছে! তার দেয়া বিভিন্ন যুক্তিমূলক বক্তৃতাকেও সমর্থন করছেন অনেকে। নারী-পুরুষ উভয়কেই তার পক্ষে অবস্থান নিয়ে নির্বাচনের মাঠে দেখা যাচ্ছে। এতে ভোট গ্রহণের দিন যত ঘনিয়ে আসছে; তাকে নিয়ে আলোচনা বেড়েই চলেছে। শেষাবধি আসলেই তিনি জনতার সমর্থন পান কিনা তা জানতে মরিয়া বেশিরভাগ মানুষ।
এনিয়ে জানতে চাইলে সাগরিকা বলেন, ‘মানুষ এখন ভিন্ন ধরনের নেতৃত্ব প্রত্যাশা করে। জীবনে অনেক বাধা পেরিয়েছি। সংগ্রাম আসলে কি- তা আমি জানি। এখন জনগণের সেবা করতে চাই। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষও সবার মতো মানুষকে ভালোবাসতে পারে এবং জনগণের সেবা করতে পারে, তা দেখিয়ে দিতে চাই। এর জন্য সুযোগটা করে দিতে ওয়ার্ডবাসীর কাছে দোয়া ও ভোট চাই।’
সুযোগ পেলে নিজের পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে দিনের আলো হিজড়া সংঘের সাধারণ সম্পাদক সাগরিকা বলেন, নির্বাচিত হলে তিনটি ওয়ার্ডেই সংরক্ষিত কাউন্সিলরের কার্যালয় করতে চাই। এতে সেবার ক্ষেত্রে কাউকে ভোগান্তি পোহাতে হবে না। জরুরি সেবার লক্ষ্যে অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থাও করতে চাই। কর্মসংস্থান তৈরির জন্য সকল নারীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উদ্যোক্তা তৈরি করার লক্ষ্যে কাজ করার ইচ্ছে আছে। ধর্মীয় শিক্ষার জন্য এলাকাভিত্তিক সুযোগ তৈরি করব। সুখে-দুঃখে হটলাইন নম্বরের মতো এলাকার পাশে থাকব। আশা করি নির্বাচন কমিশন কোনো বিতর্কিত নির্বাচন উপহার দেবে না। জনগণ ভোট দিয়ে তার পছন্দের যোগ্য প্রার্থীকে বেছে নেবে।’
উল্লেখ্য, আগামী ২১ জুন ইভিএমের মাধ্যমে রাজশাহী সিটি নির্বাচনের ভোট গ্রহণ করা হবে। এই নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৫২ হাজার ১৫৭। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৭১ হাজার ১৮৫ জন। আর নারী ভোটার ১ লাখ ৮০ হাজার ৯৭২ জন। এবার ১৫২টি ভোটকেন্দ্রের ১ হাজার ১৭৩টি কক্ষে ভোট গ্রহণ করা হবে।
সোনালী/জেআর