ঢাকা | নভেম্বর ২৫, ২০২৪ - ৩:৪৮ পূর্বাহ্ন

দেশে বিদ্যুৎ সংকট || নেপথ্যের কারণ কি

  • আপডেট: Thursday, June 8, 2023 - 4:00 am

অনলাইন ডেস্ক: নজিরবিহীন টানা তাপপ্রবাহে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। বিদ্যুতের চাহিদা এখন ১৬ হাজার মেগাওয়াট। যদিও প্রকৃত চাহিদা এর চেয়ে বেশি। বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে ২৩ হাজার ৩৭০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ চাহিদার চেয়ে উৎপাদনের ক্ষমতা ৩২ শতাংশ বেশি। এরপরও দেশজুড়ে ভয়াবহ লোডশেডিং কেন– এ প্রশ্ন এখন ঘরে-বাইরে।

গ্রামে ১০-১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। ঘাটতি ৩ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ডলার সংকটে জ্বালানি (তেল, গ্যাস ও কয়লা) আমদানি বাধাগ্রস্ত হওয়ায় চাহিদা অনুসারে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। গ্যাস, কয়লা ও ফার্নেস আমদানি এবং বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিল বাবদ বর্তমানে ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার বা ৪০ হাজার কোটি টাকা বকেয়া পড়েছে।

বিশেষজ্ঞরা ডলার সংকট ছাড়াও বর্তমান সংকটের পেছনে সমন্বয়হীনতা, অব্যবস্থাপনা ও ভুল নীতিকে দায়ী করছেন। তাঁরা বলছেন, সময় মতো ডলার ছাড় না করায় বর্তমান জ্বালানি সংকট হয়েছে। এখন চাপে পড়ে ঠিকই ডলার ছাড় করা হচ্ছে। কিন্তু যথাযথ সময়ে বিল পরিশোধ করলে কয়লা বা অন্যান্য জ্বালানি সংকট হতো না। চাহিদা অনুপাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হতো।

এছাড়া অতিরিক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, দেশীয় উৎসের চেয়ে আমদানিনির্ভর জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মতো উদ্যোগ এ খাতের ব্যয় অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন ঘন ঘন দাম বাড়িয়ে এবং ভর্তুকি দিয়েও চাপ সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, এখন যথাযথ সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার জোগান এবং নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা না গেলে এই সমস্যার আশু সমাধান হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ খাতসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নির্দিষ্ট একটি পর্যায়ে ধরে রাখার চাপ আছে। এদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ডলার ছাড়ের তাগিদ আছে। ফলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চাহিদা অনুসারে যথাযথ সময়ে পরিমাণ অনুযায়ী ডলার ছাড় বর্তমানে বেশ কঠিন।

পিডিবির কর্মকর্তাদের মতে, লোড ব্যবস্থাপনার বৈষম্য কমিয়ে ভোগান্তি কিছুটা লাঘব করা যায়। এর বাইরে অনুকূল আবহাওয়া ছাড়া উপায় নেই। বৃষ্টি হলে বিদ্যুতের চাহিদা কমবে। তখন ভোগান্তি কমতে পারে।

বিদ্যুতের সক্ষমতা কাজে লাগছে না

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য বলছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা এখন ২৩ হাজার ৩৭০ মেগাওয়াট। গত মঙ্গলবার জ্বালানির অভাবে ৫০৩৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়নি। এ ছাড়া নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের জন্য ২ হাজার ৯৭৭ মেগাওয়াট বন্ধ ছিল।

এরপরও পিডিবির হাতে ছিল ১৫ হাজার ৩৩৩ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতা। এদিনের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল রাত ৯টায় ১৫ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। অর্থাৎ ৫০০ মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সেদিন ৩০৯৩ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেড করতে হয়েছে।

এর কারণ হলো, সব বিদ্যুৎকেন্দ্র সব সময় চালানো যায় না। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে ৪৫৯ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ রয়েছে, যা সন্ধ্যার পর আর উৎপাদনে থাকে না। মঙ্গলবার দিনে সোলার থেকে সর্বোচ্চ ৩৯৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া গেছে।

৩১ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র ফার্নেস অয়েল ও ডিজেলে চলে। সক্ষমতা ৭ হাজার ১১৯ মেগাওয়াট। উচ্চ খরচ, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ধরন (পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট), দক্ষতা ধরে রাখতে এই তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো সন্ধ্যা ৭টা থেকে ১১টা পর্যন্ত বেশি চালানো হয়। গরমে বাড়তি চাহিদা সামলাতে তেলকেন্দ্রগুলো বেশি হারে চালাতে গিয়ে যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে। তাই এগুলোকে প্রায় বিশ্রামে রাখা হয়।

গত মঙ্গলবারের পরিসংখ্যান অনুসারে সন্ধ্যা ৭টা থেকে ১১টা পর্যন্ত তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে ৪ হাজার ২০০ মেগাওয়াট থেকে ৪ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। অন্য সময় এ কেন্দ্রগুলো ১৬০০ থেকে ২৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।

এ ছাড়া তেলভিত্তিক অধিকাংশ কেন্দ্র বেসরকারি মালিকানাধীন। সরকারের কাছে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের প্রায় ২০০ কোটি ডলার বিল পাওনা রয়েছে। ফলে তারা চাইলেও ফার্নেস অয়েল আনতে পারছে না। এ জন্যও উৎপাদন কম হচ্ছে।

দিনব্যাপী চালানো যায় কয়লা আর গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্র। দেশের গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রর উৎপাদন সক্ষমতা ১১ হাজার মেগাওয়াট। গত মঙ্গলবার সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল ৬ হাজার ১৬৫ মেগাওয়াট। এদিন গ্যাস সরবারহ করা হয় ১২০ কোটি ঘনফুট । পূর্ণ ক্ষমতার জন্য গ্যাস লাগে ২২০ কোটি ঘনফুট।

পেট্রোবাংলা বলছে, বর্তমানে যে গ্যাস দেওয়া হচ্ছে, এর বেশি দেওয়া সম্ভব নয়। পেট্রোবাংলা জানিয়েছে, গ্যাসের বিল বাবদ ৪৮.৮ কোটি ডলার বকেয়া পড়েছে। এর মধ্যে শেভরনের পাওনা ২২ কোটি ডলার, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির এলএনজির জন্য ১৪.২ কোটি ডলার, স্পট এলএনজির জন্য ১১.৫ কোটি ডলার এবং এলএনজি টার্মিনালগুলোর জন্য ১.১ কোটি ডলার লাগবে।

কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা ৩ হাজার ৩৬০ মেগাওয়াট। কয়লার স্বল্পতায় মঙ্গলবার উৎপাদন হয়েছে ১৬০০ থেকে ২০০০ মেগাওয়াট। কয়লা সংকটে পায়রা বন্ধ রয়েছে। রামপাল সক্ষমতার অর্ধেক উৎপাদন করছে। পায়রার কয়লা আসতে আরও তিন সপ্তাহ সময় লাগবে। পায়রার কয়লার বিল বাবদ ৩০ কোটি ডলার বকেয়া রয়েছে।

জানতে চাইলে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, চাহিদার চেয়ে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৩২ শতাংশ বেশি। ফলে জ্বালানি সংকট ছাড়াও অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসে থাকে। কিন্তু তাদের ক্যাপাসিটি চার্জের অর্থ ঠিকই পরিশোধ করতে হয়। যা বিদ্যুৎ খাতের জন্য বাড়তি বোঝা তৈরি করেছে।

গত ১২ বছরে ক্যাপাসিটি পেমেন্টের নামে ১ লাখ কোটি টাকার ওপর নিয়ে গেছে বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীরা। বিদ্যুৎ খাতের লুটপাটের জন্যই চাহিদা না থাকলেও একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র বসানো হয়েছে। দেশি গ্যাস কয়লার উত্তোলন আর অনুসন্ধানে উদ্যোগ না নিয়ে আমদানির দিকে ঝুঁকেছে সরকার। কারণ এতে কমিশন মেলে। যার কুফল এখন ভোগ করছে জনগণ।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, সরকারের অব্যবস্থাপনায় সংকট বেড়েছে। সময়মতো ডলার ছাড়লেই সংকট ঘনীভূত হতো না। তিনি বলেন, সরকার ডলার ছাড়ছে না, তা নয়। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রায় ৮৮ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ততদিনে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন কয়লা আসতে আরও তিন সপ্তাহ সময় লাগবে। এই অর্থটুকু আরও এক মাস আগে দিলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করতে হতো না। বিদ্যুৎ না পেলেও ক্যাপাসিটি পেমেন্ট হিসেবে পায়রাকে ঠিকই বড় অঙ্কের অর্থ পরিশোধ করতে হবে।

সাবেক বিদ্যুৎ সচিব মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, কেপিআইভুক্ত না হলেও কিছু কিছু এলাকায় লোডশেডিং করা হয় না। এসব কথিত ভিআইপি ফিডারে গড় লোডশেডিং দিলে ৬০০-৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে, যা অন্যদের দেওয়া যাবে। তিনি বলেন, আমি দায়িত্বে থাকাকালে এভাবে প্রায় ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় করেছিলাম।

জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, গরম অনেক বেড়ে গেছে। এ জন্য বিদ্যুৎ বেশি লাগছে। কিন্তু জ্বালানি সংকটের কারণেই বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে। এখন ডলার ছাড় হয়েছে। এলসি খোলা হয়েছে। পায়রার কয়লা আসবে। ২০-২৫ দিন সময় লাগবে। এর আগে গত রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী বলেন, দুই মাস আগে সমস্যার (পায়রার জন্য ডলার সংকট) বিষয়টি জানা যায়। তখন থেকে চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু অর্থনৈতিক বিষয় থাকে। এলসি খোলার বিষয় থাকে। সব সমন্বয় করতে হয়। আমরা বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রস্তুত করে বসে আছি। কিন্তু জ্বালানি আসার পেছনের সব বিষয়ে আমাদের হাতে নেই। সমন্বয় কোথাও বাধাগ্রস্ত হলে সমস্যা হয়। এবারও তাই হয়েছে।

মঙ্গলবার সংসদে প্রতিমন্ত্রী বলেন, প্রয়োজনীয় জ্বালানি পেলে প্রতিদিন ২০ থেকে ২২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে সরকার। জ্বালানি সংকটে এখন দিনে ১২ হাজার মেগাওয়াট এবং রাতে ১৪ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন হচ্ছে।

দেশীয় জ্বালানির বিষয়ে তিনি বলেন, নিজেদের জ্বালানির সর্বোত্তম ব্যবহার করছি। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার জন্যও অর্থ লাগে। এক একটি কূপ খননের জন্য ৯ থেকে ২১ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হয়। তার পরও সরকার তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দিয়েছে।

দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনায় ভুল নীতির বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, সমালোচনা করা সহজ। কিন্তু সরকারকে সব বিষয় সার্বিকভাবে দেখতে হয়। জ্বালানির বৈচিত্র্য আনতে তেল, কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। আমাদের যতটুকু বাড়তি সক্ষমতা রয়েছে, তা আন্তর্জাতিক মানসম্মত। এটুকু বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা কমবেশি সব দেশেই আছে। জ্বালানির দাম বিশ্বব্যাপী বেড়ে যাওয়ায় আমরা সংকটে পড়েছি। তাই বিদ্যুৎ কম উৎপাদিত হচ্ছে। সরকারের পরিকল্পনা ঠিক আছে বলে তিনি দাবি করেন।

সোনালী/জেআর