ভিসা নীতি: নয়া হিসাব-নিকাশে আ’লীগ ও বিএনপি
অনলাইন ডেস্ক: যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতিতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে চলছে নতুন হিসাবনিকাশ। বুধবার রাতে সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা দিলে নিজের এবং পরিবারের সদস্যদের যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। বিষয়টি নিয়ে জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে নানা প্রশ্ন! তাহলে কি আগামী সাত-আট মাস পর দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক এবং অবাধ ও সুষ্ঠু হবে? নাকি যেভাবে হওয়ার তাই হবে?
অবশ্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি প্রকাশ্যে এই সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক বলে ‘স্বাগত’ জানলেও ভেতরের ভিন্ন চিত্র। এ সিদ্ধান্তের সুদূরপ্রসারী ‘প্রভাব’ নিয়ে চিন্তিত দলগুলোর নীতিনির্ধারকরা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের পরিকল্পনা এবং চলমান আন্দোলন নিয়ে বিরোধী দলের রাজনৈতিক কৌশল ও হিসাবনিকাশ বদলাতে হবে বলে মনে করছেন দল দুটির শীর্ষ নেতারা।
আবার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এ সিদ্ধান্ত সবার জন্যই ‘সতর্কবার্তা’। শুধু রাজনীতিবিদ নন সরকারি কর্মকর্তা, বিচারক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়িত্বশীল হতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে বামদলের নেতারা দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাক গলানোকে ইতিবাচক হিসেবে নেননি। স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশে এ হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য সরকারকে দায়ী করে কঠোর সমালোচনা করেন তাঁরা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক গতকাল বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা দিলে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞার যে হুঁশিয়ারি দিয়েছে, সেই বিষয়ে সরকার চিন্তিত নয় ও চাপ অনুভব করছে না। এটি সবার জন্য সতর্কবার্তা। বিএনপির জন্যও প্রযোজ্য। আমরা আমাদের বিবেক দিয়ে পরিচালিত হচ্ছি। কাজেই এটি নিয়ে আমাদের কোনো ভয় নেই। সে ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান খুবই সুস্পষ্ট। নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে যেটি সঠিক নয়– আমরা সেটি করব না। এমন কিছু করব না যেটির মাধ্যমে আমাদের কেউ ভিসা থেকে বঞ্চিত হয়।
তিনি আরও বলেন, কেউ যদি নির্বাচনে না আসে সেটা তাঁদের দায়িত্ব। তবে আমরা শেষ দিন পর্যন্ত চেষ্টা করব সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার জন্য। জনগণ, কূটনীতিক ও প্রশাসনসহ সবাইকে নিয়ে একটা নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও আন্তর্জাতিক উইংয়ের প্রধান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতিকে তাঁরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য বিএনপিসহ দেশের গণতন্ত্রপ্রিয় জনগণ দীর্ঘদিন ধরে যে দাবি জানিয়ে আসছিল, মার্কিন এই ভিসা নীতিতে তারই সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে। তাঁদের বিশ্বাস, বর্তমান ফ্যাসিবাদী সরকারের অধীনে কোনোভাবেই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না। কেবল একটি নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই তা সম্ভব।
আর সে কারণেই বিএনপি দেশের সব গণতান্ত্রিক দল ও শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আদায়ের লক্ষ্যে নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করে চলছে। তবে সরকার নানা কূটকৌশলের মাধ্যমে আবারও সুষ্ঠু নির্বাচনের মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছে। আশা করি, এবার আর কেউ তাঁদের আর তা বিশ্বাস করবে না।
সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বস্ত করার চেষ্টায় সরকারি দল
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানায়, প্রকাশ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বিষয়টিকে স্বাগত জানালেও ভেতরে-ভেতরে ভালোভাবে নেয়নি ক্ষমতাসীন দলটি। কার্যত বিগত জাতীয় নির্বাচনগুলোকে নেতিবাচক অর্থাৎ সুষ্ঠু ও অবাধ হয়নি মনে করেই যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার হুমকি দিয়েছে বলেই মনে করেন তাঁরা।
এতে বিশ্বের দরবারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তথা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও ক্ষুণ্ণ হয়েছে এবং তারা কমবেশি চাপে পড়েছে। মুখে শীর্ষ নেতারা যতই সবার জন্য এ সতর্কবার্তা প্রযোজ্য বলুক না কেন– কিন্তু কোন পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা খতিয়ে দেখছে।
ক্ষমতাসীন দলটির নেতারা আরও জানান, ভিসা নীতিকে প্রকাশ্যে গুরুত্ব না দিলেও এটিকে তাঁদের জন্য এক ধরনের সতর্কবার্তা মনে করছেন তাঁরা। এ পরিস্থিতিতে আগামীতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা দলটির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। নির্বাচনের আগে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখার চেষ্টা করবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও গণহারে গ্রেপ্তারের পথ পরিহার করতে হতে পারে। বিশেষ করে বিরোধী দলের ওপর নতুন করে নির্যাতন, সভা-সমাবেশে বাধা দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
আশ্বাসে ‘আশ্বস্ত’ হলে বেকায়দায় পড়ার শঙ্কা বিরোধী দলের
বিএনপির সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতিমালাকে স্বাগত জানিয়েছে তারা। আপাতত দৃষ্টিতে সিদ্ধান্তটি তাঁদের পক্ষেই গেছে বলে মনে করেন দলটির নেতারা। যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে তাঁরা আন্দোলন করছেন, তারই পক্ষে সিদ্ধান্তটি এলো। আবার সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের বিষয়টি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা নেই। কারণ দলীয় সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলেই তাঁরা নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছেন। এখন এই আন্দোলনকে সরকারি দলের দাবি অনুযায়ী আবার সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে তাঁরা বাধা মনে না করেন!
বিএনপি সূত্রমতে, এখন ক্ষমতাসীন দল যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আশ্বস্ত করে, তাদের অধীনেই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। বিদেশিরা যদি এতে আশ্বস্ত হয়ে বিরোধী দলের চলমান আন্দোলনের ব্যাপারে ‘নেতিবাচক’ মনোভাব ব্যক্ত করে, তা কোনোমতেই কাম্য হবে না।
কারণ সরকার কৌশলী ভূমিকা নিয়ে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বিরোধী দলের সঙ্গে সংযত আচরণ করতে পারে। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনের মতো যদি আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্বপদে থাকেন এবং রাষ্ট্রের ওপর ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব থাকে– সেই গোপন শক্তি তারা কাজে লাগাবেই।
বিএনপি নেতাদের মতে, সরকারি দল বিদেশিদের সামনে লোক দেখানো একটি পথ খোলা রাখতে পারে। ফলে বিদেশিদের ‘ধোঁকা’ দিয়ে নির্দলীয় সরকারের দাবি না মেনেই বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচনে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। যাতে বিরোধী দলগুলোর ঐক্য ধরে রাখা কঠিন হতে পারে।
পাশাপাশি বিদেশিরা আশ্বস্ত হয়ে গেলে সরকারের ওপরও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের বিষয়ে ‘চাপ’ও থাকবে না। তাদের ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু নির্বাচনে সে আশ্বাস রক্ষা করেননি তিনি। ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে নতুন কোনো কূটকৌশল নিতে পারে বলে মনে করেন বিএনপি নেতারা।
যা বললেন অন্য রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম গতকাল বলেছেন, এটা সেই আমেরিকা, যারা ১৯৭০ সালে জনগণের ম্যান্ডেট দেওয়ার পরও ক্ষমতা হস্তান্তর না করা পাকিস্তানকে সহযোগিতা করেছিল। অনেক বছর ধরে বাংলাদেশে একের পর এক প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকা দলকে তারা সমর্থন করেছে। জনগণকে ভোটাধিকার বঞ্চিত করার জন্য সবার আগে তাদের ক্ষমা চাওয়া উচিত। দেশে যখন ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের আন্দোলন চলছে, তখন জনগণকে লক্ষ্যচ্যুত করতে তারা অযাচিত হয়ে নাক গলাচ্ছে। এটি একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের জন্য খুবই অসম্মানজনক।
এ ঘটনার সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত। আধিপত্যবাদী দেশ আমেরিকার এ সিদ্ধান্তের পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। আর তাদের নাক গলানোর সুযোগ করে দিয়েছে বর্তমান সরকার ভোটাধিকার হরণ করার মধ্যমে। নগ্ন এবং অসম্মানজনকভাবে এই সুযোগ করে দেওয়ার জন্য জাতির কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তদারকি সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু আগামী নির্বাচনের দাবিতে চলমান আন্দোলনের কাছে সরকার নতিস্বীকার ছাড়া এ সমস্যার কোনো সমাধান হবে না বলে জানান তিনি।
বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহ্দীন মালিক গতকাল বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতিতে আগামী নির্বাচনে কিছুটা হলেও প্রভাব পড়বে। কারণ শুধু যুক্তরাষ্ট্রে ভিসা না পেলে গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য দেশের ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আর এতে শুধু রাজনীতিবিদ নয়, সংশ্লিষ্ট বিচারক, সরকারি কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ সবার জন্য একটি সতর্কবার্তা। আমাদের নির্বাচনে অতীতে আইনভঙ্গের উৎসব হয়ে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের কারণে আগামী নির্বাচন অসৎ পথে আগানোর পরিকল্পনা থেকে সরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। জোর যার মুল্লুক তার– ভাবনা থেকে সরে এসে নির্বাচনী আচরণ মানা নিশ্চিত করতে পারে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে আইন-কানুন মানার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে হবে।
সোনালী/জেআর