ঢাকা | জুন ৯, ২০২৫ - ৪:০৭ অপরাহ্ন

যে হ্রদ একরাতেই কেড়ে নেয় হাজারো মানুষের প্রাণ

  • আপডেট: Sunday, May 14, 2023 - 1:52 am

অনলাইন ডেস্ক: ১৯৮৬ সালের ২১ অগস্ট। অন্য আর পাঁচটা দিনের মতোই ব্যস্ত ছিল লোয়ার নিয়োস গ্রামের রাস্তাঘাট। অন্য দিনের মতোই নৈশভোজ সেরে তাড়াতাড়ি শুতে গিয়েছিলেন গ্রামের বাসিন্দারা।

পর দিন সকালে, প্রায় ১৭০০ মানুষ এবং ৩ হাজার গবাদি পশুর মৃতদেহ উদ্ধার হয় গ্রাম থেকে। রাতারাতি অর্ধেক হয়ে যায় গ্রামের জনসংখ্যা। কিন্তু কী করে এক রাতে গ্রামের এত মানুষের এক সঙ্গে মৃত্যু হয়েছিল? তা খুঁজে পেতে হিমশিম খেতে হয় প্রশাসনকে।

সেই সময় গুজব ছড়িয়েছিল, কোনও গোপন সরকারি, অদৃশ্য মহাস্ত্র বা ‘ভিন্‌গ্রহী’দের অতর্কিত আক্রমণের কারণেই মৃত্যু হয়েছে আফ্রিকার ওই গ্রামের ১৭০০ মানুষের।

তবে লোয়ার নিয়োস গ্রামের এতগুলি মানুষের একসঙ্গে মৃত্যুর নেপথ্য কারণ ছিল অন্য।

দীর্ঘ গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছিলেন লোয়ার নিয়োস গ্রামের পাশে থাকা একটি হ্রদের কারণেই মৃত্যু হয়েছিল গ্রামের ১৭০০ মানুষের। মারা গিয়েছিল গ্রামের তিন হাজার গবাদি পশুও।

লোয়ার নিয়োস গ্রামের মানুষ জানতেন না যে, লেক নিয়োস হ্রদের তলায় রয়েছে একটি ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মুখ।

নিয়োস হ্রদের অবস্থান ক্যামেরুন আগ্নেয়গিরির কাছে। গিনি উপসাগর থেকে ক্যামেরুন এবং নাইজেরিয়া পর্যন্ত দেড় হাজার কিমি জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে একটি আগ্নেয়গিরিমালা।

এই আগ্নেয়গিরিমালার উৎপত্তি কী ভাবে তা এখনও সম্পূর্ণ ভাবে বোঝা যায়নি। মনে করা হয়, ১৫০০ লক্ষ বছর আগে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আফ্রিকার বিচ্ছেদের সময়, একটি ফাটল তৈরি হতে শুরু করেছিল। সেই কারণে এই আগ্নেয়গিরিমালার উৎপত্তি।

বর্তমানে সেই আগ্নেয়গিরিমালার একমাত্র সক্রিয় আগ্নেয়গিরি মাউন্ট ক্যামেরুন। আগ্নেয়গিরিমালার নিচে ৮০ কিমি গভীরে এখনও একটি বড় লাভার প্রকোষ্ঠ রয়েছে।

লাভার প্রকোষ্ঠ থেকে মাঝেমধ্যেই প্রচুর পরিমাণ গ্যাস নির্গত হয়। দীর্ঘ সময় ধরে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মুখের উপর যদি প্রাকৃতিক নিয়মে কোনও হ্রদ বা জলাভূমি সৃষ্টি হয় তা হলে সেই গ্যাস ওই হ্রদ বা জলাভূমি বরাবর প্রবাহিত হয়। আগ্নেয়গিরির মুখের উপর তৈরি হওয়া ওই হ্রদগুলিকে ‘মার হ্রদ’ বলা হয়।

আগ্নেয়গিরিমালার আশপাশে ওই ধরনের মোট ৩০টি হ্রদ রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম নিয়োস। পাহাড়ে ঘেরা নিয়োস হ্রদটির গভীরতা ৬৫০ ফুটেরও বেশি।

লাভা প্রকোষ্ঠ থেকে উৎপন্ন সালফার এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মতো গ্যাস ওই হ্রদগুলির তলায় ঘনীভূত অবস্থায় থাকে। গ্যাসগুলিকে তলদেশেই আটকে রাখতে ওই ধরনের হ্রদগুলির উপরিভাগে প্রাকৃতিক নিয়মেই একটি উষ্ণ জলের আচ্ছাদন তৈরি হয়।

বিজ্ঞানীদের দাবি, যে রাতে লোয়ার নিয়োস গ্রামে ওই বিপর্যয় ঘটে, সে রাতে কোনও ভাবে নিয়োস হ্রদের উপরের সেই নিরাপত্তা বলয় ভেঙে যায়। উষ্ণ জলের আচ্ছাদন ভেদ করে বেরিয়ে আসে বিষাক্ত গ্যাসের মেঘ।

স্থানীয় কয়েক জনের দাবি, বিপর্যয়ের ঠিক আগে নিয়োস হ্রদের আশেপাশে একটি বিকট শব্দ শোনা গিয়েছিল। যার পরই নাকি জলের তলা থেকে উঠে আসে বিষাক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ঘন মেঘ।

নিয়োস হ্রদের উপরে ১৬০ ফুট পর্যন্ত উঠে গিয়েছিল সেই বিষাক্ত মেঘের স্তর। সেই মেঘের ঘনত্ব সাধারণ বাতাসের থেকে বেশি হওয়ার কারণে তা ভূপৃষ্ট থেকে বেশি দূর পর্যন্ত উঠতে পারেনি।

বিষাক্ত মেঘের স্তর উপত্যকা বরাবর উড়ে গিয়ে লোয়ার নিয়োস গ্রাম পর্যন্ত ভেসে যায়। সেখানে গিয়ে অতিরিক্ত ভারের কারণে সেই বিষাক্ত গ্যাসের মেঘ ভেঙে যায়। ছড়িয়ে পড়ে পুরো গ্রাম জুড়ে।

বিষাক্ত গ্যাসের কারণে ঘুমের মধ্যেই মৃত্যু হয় বহু গ্রামবাসী এবং গবাদি পশুর। বিপর্যয় থেকে বেঁচে যাওয়া কয়েক জন জানিয়েছিলেন তাঁরা রাতের অন্ধকারে সালফারের গন্ধ পেয়েছিলেন।

পৃথিবীর বুকে নিয়োসের মতো ‘খুনে হ্রদ’ খুব বিরল। লোয়ার নিয়োসের বিপর্যয়ের আগে ১৯৮৪ সালের ১৫ অগস্ট একই রকম এক ঘটনায় ক্যামেরুনে আগ্নেয়গিরির পাশে থাকা লেক মনুনের কাছের গ্রামে ৩৭ জন স্থানীয় মারা যান। সূত্র: আনন্দবাজার

সোনালী/জেআর

Hi-performance fast WordPress hosting by FireVPS