ঢাকা | মে ১৮, ২০২৪ - ১১:৩৭ পূর্বাহ্ন

করোনা: শিক্ষায় বড় বিপর্যয়

  • আপডেট: Saturday, March 11, 2023 - 11:00 am

অনলাইন ডেস্ক: করোনা মহামারির প্রভাবে বড় বিপর্যয় ঘটেছে শিক্ষাব্যবস্থায়। করোনা-পরবর্তী স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় নিয়মিত পাঠদান কার্যক্রম চালু হলেও এখনো স্বাভাবিক হয়নি পরিস্থিতি।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করোনায় দেড় বছর বন্ধ থাকায় ছাত্রছাত্রীরা ব্যাপকভাবে প্রাইভেট-টিউশনির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থীদের এখনো অনেকটা সময় কাটছে মোবাইল ফোনে গেম খেলেই। শিক্ষার্থীদের কমে গেছে শিখনদক্ষতা, বেড়েছে ফেল করার হার। হবিগঞ্জ জেলায় ফেলের হার বেড়েছে সব থেকে বেশি। বেসরকারি সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযানের করোনা-পরবর্তী শিক্ষা পুনরুদ্ধার শীর্ষক ‘এডুকেশন ওয়াচ স্টাডি-২০২২’ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। শিগগিরই এটি প্রকাশ করা হবে বলে জানা গেছে।

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করার পর মতামত জানতে সরকারের শিক্ষাসংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাছে পাঠানো হয়েছে। আগামী মাসে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। তবে এ জরিপ নিয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

তথ্যমতে, মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি ও গণিতের শিখন ঘাটতি পরিমাপ করতে এ জরিপ করা হয়। জরিপের আওতায় আনা হয়েছে প্রাথমিকের কিছু শিক্ষার্থীকেও। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নানান তথ্য আমলে নেওয়া হয়েছে জরিপে। সব মিলে ১ হাজার ১৫১ শিক্ষার্থী, ৫৬২ শিক্ষক, ৫৮৪ অভিভাবক, শিক্ষা কর্মকর্তা, বেসরকারি সংস্থা, পরিচালনা পর্ষদসহ বিভিন্ন অংশীজনের থেকে তথ্য নিয়ে এ জরিপ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। ওই প্রতিবেদন প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। ওই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, করোনার কারণে শেখার দক্ষতা কমেছে শিক্ষার্থীদের।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসাররা বলছেন, করোনার আগে শিক্ষার্থীদের ১০ এর স্কেলে শিখনদক্ষতা ছিল ৮ দশমিক ৬, কিন্তু করোনার প্রকোপের পর এ দক্ষতা ৫ দশমিক ৮-এ এসে ঠেকেছে। অষ্টম ও নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে জরিপ চালিয়ে গণসাক্ষরতা অভিযান বলছে, ইংরেজিতে প্রায় ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে। আর গণিতে এ হার ৩৪-এর বেশি।

তবে বাংলায় ৮২ শতাংশ শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছে। অকৃতকার্য শিক্ষার্থীর মধ্যে মেয়ের থেকে ছেলের সংখ্যাই বেশি। জেলাভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পাসের ক্ষেত্রে সব থেকে পিছিয়ে হবিগঞ্জ।

এ জেলায় ৫৭ দশমিক ১ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে। ফেলের হারে তার পরই রয়েছে রাজশাহী। এ জেলায় ফেল করেছে ৪৬ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী। করোনার প্রভাবে অন্য জেলাগুলোয়ও বেড়েছে অকৃতকার্যের হার। ভোলায় ২৫ দশমিক ৪, চট্টগ্রামে ২৪ দশমিক ৮, ঢাকায় ১৫ দশমিক ৫, গাইবান্ধায় ২৮ দশমিক ৪ ও নেত্রকোনায় ১৫ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে।

পরিসংখ্যান বলছে, পাসের হারে সব থেকে এগিয়ে যশোর জেলা। এ জেলার ৯০ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছে। আর মাত্র ৯ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে। শতভাগ জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা করোনার প্রভাবে শিখন ঘাটতি হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন।

প্রাথমিকের ৭১ দশমিক ৫ ও মাধ্যমিকের ৭৫ দশমিক ১৭ শতাংশ অভিভাবক বলেছেন, শিখন ঘাটতি পোষাতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তা ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করোনায় দেড় বছর বন্ধ থাকায় ছাত্রছাত্রীরা ব্যাপকভাবে প্রাইভেট-টিউশনির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মফস্বলে ৯১ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী কোচিং সেন্টার বা টিউশনির সাহায্য নিয়েছে।

আর শহর এলাকায় ৮৮ শতাংশ ছাত্রছাত্রী নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে টিউশনির ওপর। এমনকি রাজধানীতে টিউশনির ওপর নির্ভর করছে ৭৩ দশমিক ৬ শতাংশ ছাত্রছাত্রী, যা পরিবারে অর্থ ব্যয়ে বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবেদন বলছে, সারা দেশেই ছিল এ চিত্র। করোনাকালে স্মার্টফোন বা ডিজিটাল ডিভাইসে যুক্ত থাকায় আসক্তিও বেড়েছে শিক্ষার্থীদের।

গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রতিবেদন বলছে, প্রাথমিকের ২৭ দশমিক ৫ ও মাধ্যমিকের ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী মোবাইল ফোনে গেম বা কম্পিউটার গেমে আসক্ত হয়ে পড়েছে। প্রাথমিকের ৯২ দশমিক ৩ ও মাধ্যমিকের ৮১ দশমিক ১ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রতিনিয়ত কমপক্ষে এক থেকে দুই ঘণ্টা মোবাইল ফোন/কম্পিউটারে গেমে পার করে। অনেক স্থানে শিক্ষার্থীরা চার ঘণ্টার বেশি নষ্ট করছে এসব গেম খেলেই।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, করোনার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে এটি অস্বীকারের উপায় নেই। কিন্তু ঘাটতি মেটাতে সারা দেশের প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষদের বাড়তি ক্লাস নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। করোনার দুই বছরের ঘাটতি পোষাতে কিছুটা সময় লাগবে।

আর করোনায় শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ সময় বাড়িতে অবস্থান করায় এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি। ডিজিটাল ডিভাইস বা মোবাইল ফোনে তারা এখনো অনেকটা সময় ব্যয় করছে। এখন স্কুল-কলেজে পুরোদমে ক্লাস চলছে। তাই আশা করছি করোনার নেতিবাচক নানান প্রভাব কেটে যাবে।

গণসাক্ষরতা কেন্দ্রের প্রতিবেদন বলছে, প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সর্বনিম্ন আড়াই হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকা ব্যয় করেছে প্রাইভেট টিউশনিতে। আর মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা ব্যয় করেছে ২ হাজার ৪০০ থেকে ৯৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করোনায় দেড় বছর বন্ধ থাকায় বিস্তার ঘটেছে নিষিদ্ধ নোট-গাইডেরও। প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, মাধ্যমিকের ৮২ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী নোট-গাইডের সাহায্য নিয়েছে। আর প্রাথমিক স্তরে নোট-গাইডে নির্ভর হয়ে পড়েছিল ৭৮ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, করোনার সময় অটো প্রমোশন, শর্ট সিলেবাস ও কম পড়িয়ে পরীক্ষা নেওয়ার কারণে বড় শিখনশূন্যতা তৈরি হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী ফেল করছে, কেউ একেবারেই ঝরে পড়ছে। এ ছাড়া শর্ট সিলেবাসে এসএসসি-এইচএসসি পাস করে অনেক ছাত্রছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় পাসও করতে পারছে না। এগুলো শিখনশূন্যতার প্রমাণ।

আর এ শূন্যতা কাটিতে উঠতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। শিক্ষার্থীদের শিখনক্ষমতা কমেছে আর ফেলের সংখ্যা বেড়েছে, যা গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। শিক্ষা খাত নিয়ে গভীরভাবে না ভাবলে ভবিষ্যতে আরও দুর্যোগ পোহাতে হবে। পরিস্থিতি উত্তরণে বেশ কিছু সুপারিশ করেছে গণসাক্ষরতা অভিযান। ঘাটতি পোষাতে অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়া, পড়ানোর ধরন আরও আকর্ষণীয় করা, দুর্বল শিক্ষার্থীদের প্রতি নজর দেওয়া, মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের সুবিধা বৃদ্ধিসহ বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সোনালী/জেআর