ঢাকা | জুলাই ২৬, ২০২৪ - ২:০৮ অপরাহ্ন

ছাত্রলীগ বেপরোয়া কেন?

  • আপডেট: Thursday, March 2, 2023 - 1:44 am

আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। সম্প্রতি সেখানকার এক ছাত্রীকে বিবস্ত্র করে রাতভর মারধর এবং সে দৃশ্য ভিডিও করা হয়েছে। ভিকটিম ফুলপরীর ‘অপরাধ’– সে কেন ছাত্রলীগ নেত্রীদের অনুমতি ছাড়া হলে উঠল। তবে আমার মনে হয়, ফুলপরী যদি কোনো প্রভাবশালী পরিবারের মেয়ে হতো; রাজনৈতিক-প্রশাসনিক কানেকশন থাকত, তবে ছাত্রলীগ নেত্রীরা তার ওপর নির্যাতনের আগে দশবার ভাবত। ভ্যানচালকের কন্যা ফুলপরীর ওপর নির্যাতনে তাদের হাত একটুও কাঁপেনি! বিষয়টি শ্রেণি-সম্পর্কিত।

ছাত্রলীগ নেত্রীরা ইডেনের এক ছাত্রীকেও বেধড়ক পিটিয়েছে। অল্প দিনের ব্যবধানে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও। এসব ঘটনা সাংবাদমাধ্যমে এসেছে। সংবাদমাধমে আসছে না– এমন ঘটনাও অনেক। ছাত্রলীগ কোনো কিছুই পরোয়া করছে না। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, সিট বাণিজ্য, শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করা, শিক্ষার্থীদের নির্যাতন, ছিনতাই, যৌন নিপীড়নসহ নানা অপকর্ম সারাদেশেই আলোচিত-সমালোচিত।

ছাত্রলীগ আজ ছাত্র রাজনীতির মর্যাদা ধুলায় লুটিয়ে দিয়েছে। একদা ছাত্র রাজনীতি ছিল সম্মান ও গৌরবের। সাধারণ মানুষ আপদে-বিপদে ছাত্রনেতার কাছে ছুটে আসত। যখন পাটের ন্যায্য দাম পাওয়া যাচ্ছে না; বাজারে সার-বীজ মিলছে না; ছাত্র সংগঠনই ছিল তাদের ভরসা। তারা কৃষকের দাবিদাওয়া নিয়ে রাজপথে নামত। দাবি আদায়ও হতো। এমনকি গ্রাম্য কোন্দল মেটাতেও ছাত্রনেতাদের শরণাপন্ন হতো।

আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের ঢেউ গ্রামেও লেগেছিল। আমাদের এলাকায় গ্রামে গ্রামে মাতব্বরদের বয়কট করে পাবলিক পার্টি গড়ে ওঠে। তাদের ঘোষণা– মাতব্বরের মাতব্বরি চলবে না। আমজনতা নিজেরাই নিজেদের গ্রাম্য কোন্দল মেটাবে। মিটিয়েছিলও। আমাদের গ্রামের দুই-তিনটি বিরোধ মেটানোর জন্য বৈঠক ডাকা হয়। সাধারণ মানুষই সমাধানে উপনীত হয়। কিন্তু রায় ঘোষণার জন্য একজন ছাত্রনেতাকে দরকার। সেই রায় ঘোষণার জন্য আমাকে ডাকা হয়। ছাত্রলীগ তথা ছাত্র আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে এটি ছিল আমার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা।

অনেকের মতো আমিও হতবাক। ভাবতে পারি না– এই সেই সংগঠন, যাদের ভূমিকা ইতিহাসে সমুজ্জ্বল! ১৯৪৮-৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলনে সংগঠনটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম কান্ডারি। ’৭১ সালে ছাত্রলীগই স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে এবং ইশতেহার পাঠ করে আন্দোলনকে স্বাধীনতার সিংহদ্বারে পৌঁছে দিয়েছিল। সর্বশেষ স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও ছাত্রলীগ অন্যতম নেতৃত্বদানকারী সংগঠন।

আমি বিশ্বাস করি, আজও ছাত্রলীগে নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা আছে। দুর্জনের দাপটে তারা কোণঠাসা, নির্বিকার। এখন দুর্বৃত্তদেরই আধিপত্য। প্রশ্ন– এ দায় কার? ছাত্রলীগ নেতৃত্বকে অবশ্যই এই দায় নিতে হবে। কলুষমুক্ত হওয়ার চেষ্টা তাদেরই করতে হবে। তবে কোনো পরিবর্তন ঘটবে না, যতক্ষণ তাদের অধঃপতনের কারণগুলো নির্ণয় না করা হয়। আসলে হাল আমলের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যেই অধঃপতনের বীজ নিহিত।

দেশের মূল রাজনীতিতে যখন অবৈধ সম্পদ আহরণের প্রতিযোগিতা চলছে, তখন তার প্রভাব কি ছাত্রনেতা-কর্মীর ওপর পড়বে না? তারা দেখছে যে, এক শ্রেণির রাজনীতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে ধনের পাহাড় গড়ছেন। তারা নিন্দিতও হচ্ছে না। বরং বারবার মনোনয়ন বাগিয়ে এমপি-মন্ত্রী হচ্ছেন। তরুণ কর্মীদের হাতে রাষ্ট্রিক ক্ষমতা নেই। তাই তারা বড় নেতাদের লাঠি হয়েও টু পাইস কামাচ্ছে। এভাবে হাত পাকানোর পর নিজেরাই চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি করছে। বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের নির্মাণকাজ থেকে চাঁদা, ক্যান্টিনের বখরা, হলের সিট বণ্টনের মাধ্যমে অর্থ আদায় ইত্যাদিও তাদের অর্থ সংগ্রহের ক্ষেত্র। এর বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত প্রতিবাদ-প্রতিরোধ নেই। বিচ্ছিন্নভাবে দুই-একজন প্রতিবাদী হয়ে নিগ্রহ-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এক শ্রেণির ভিসি-প্রভোস্ট-শিক্ষক তাদের সহযোগী, অন্যরা তাদের হাতে জিম্মি। প্রতিবাদী শিক্ষকদের হতে হচ্ছে লাঞ্ছিত। বলাবাহুল্য, শিক্ষাঙ্গনের সমস্যাও গণতন্ত্রের। বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের সুস্থ ও মুক্ত পরিবেশের জন্য বড় হুমকি একক আধিপত্য, যা শিক্ষার্থীদের গণতন্ত্র চর্চার পথ সংকুচিত করেছে।

একক আধিপত্য বিস্তারের সূচনা করেছিল ছাত্রদল। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রদল বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস-হল থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করে এবং নানা অপকর্ম শুরু করে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ছাত্রলীগ একই কাজ করেছে। তারাও ছাত্রদলকে শিক্ষাঙ্গনছাড়া করেছে।

এখানেই শেষ নয়; গণতন্ত্রের দাবিদার আওয়ামী লীগ-বিএনপির শাসনামলে ছাত্র সংসদগুলোকে পঙ্গু করে দেওয়া হলো। স্বৈরাচারী এরশাদ আমলেও ডাকসু, রাকসু, চাকসু ইত্যাদি ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতো। তখন ছাত্রনেতাদের মধ্যে শিক্ষার্থীদের সমর্থন ও ভালোবাসা পাওয়ার প্রতিযোগিতা থাকত। এখন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কিছু চাওয়ার নেই। তবে দলীয় মিছিল-সমাবেশে তাদের দরকার হয়; তা অবশ্য হুমকি-ধমকি, কিল-থাপ্পড়ের মধ্য দিয়ে সম্ভব। তখন নির্বাচিত সংসদ ঘিরে সাহিত্য, সংগীত, বিতর্ক, আবৃত্তি, খেলাধুলা, নানামুখী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড হতো। ছাত্র সংসদ না থাকায় তাতে এখন ভাটার টান। মুক্তিবুদ্ধির চর্চা নেই। আগে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে যে মতাদর্শিক সংগ্রাম, বাহাস, বিতর্ক ছিল; তা অনুপস্থিত। এখন এক দল অন্য দলকে বরদাশত করতে পারছে না। একই দলের এক নেতা অন্য নেতাকে সহ্য করছে না। তাই এক নেতার হাতে দলের অপর নেতা খুন হচ্ছে। এ খুনোখুনির মূলে ক্ষমতা, অর্থ, প্রতিপত্তি। আদর্শ বলে কিছু নেই। নীতি-নৈতিকতা নেই; তাদের সামনে নেই বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন, ভাসানী, মণি সিংহের মতো অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাই ছাত্রনেতারাও হাল আমলের রাজনীতিকদের মতো অর্থের পেছনে ছুটছে। প্রতিযোগিতায় নেমেছে– কে কীভাবে অর্থবিত্ত করবে।

এই নৈরাজ্য, খুনোখুনির মধ্যে আশার আলো জ্বেলেছিল ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচন। কিন্তু ছাত্রলীগ ডাকসুর সহসভাপতি পদে পরাজয় মেনে নিতে পারেনি। তাই নির্বাচিত ডাকসু সহসভাপতি নুরকে নানাভাবে নাজেহাল করেছে। এখনও করছে। সম্ভবত এই কারণে ক্ষমতাসীনরা আর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ঝুঁকি নিতে নারাজ। একক রাজত্ব বজায় রাখাই ক্ষমতাসীনদের সিদ্ধান্ত। যদিও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলেন, নির্বাচন দেওয়ার বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এখতিয়ার; তাদের কিছু করার নেই। কথাটি কেতাবি সত্য। বাস্তব সত্য হচ্ছে– কোন উপাচার্যের ঘাড়ে কয়টা মুণ্ডু যে, সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে যাবেন! আর যাবেনই বা কেন? উপাচার্য অনেকেরই দলের প্রতি আনুগত্য দলীয় ক্যাডারদের থেকেও অধিক।

ছাত্রলীগের এই দৌরাত্ম্যে আওয়ামী লীগও বিব্রত। দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রায়ই ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডের খোলামেলা সমালোচনা করেন। অনেক নেতাই ছাত্রলীগ নেতাদের ভর্ৎসনা ও নসিহত করেন। তাঁরা বিশ্বজিৎ হত্যা, বুয়েটের আবরার হত্যাসহ কতিপয় ঘটনার নিন্দাও জানিয়েছেন। বিপথগামী কর্মীদের পাশে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ দাঁড়ায়নি। এর মানে এই নয় যে, ক্ষমতাসীনরা ছাত্রলীগকে সুপথে আনতে সব অপরাধীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আইনি ও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে। আমার বিশ্বাস, তারা চাইছে ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্যের খানিকটা নিয়ন্ত্রণ; সংগঠনটির খোলনলচে বদলাতে চাইছে না। এই চাওয়াতেই গলদ। ছাত্রলীগকে অপরাধমুক্ত রাখতে হলে প্রথম কাজ– সংগঠনটিকে হীন রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা চলবে না। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ প্রচলিত ধারার দলগুলো সহযোগী বা অঙ্গ ছাত্রসংগঠনকে ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ। এতে নাকি সমূহ ক্ষতি! এর কারণ প্রকাশ্যে না বললেও ঘরোয়া আলোচনায় অনেকের মুখেই শুনেছি_ এরাই তো হাতের পাঁচ। বিপদে লাঠি হয়ে কাজ করে, সভা-সমাবেশে লোক জোগান দেয়, ভোট করে, প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করে। এরা আরও অনেক কাজের কাজি।

এটি সত্য, মূল রাজনৈতিক নেতৃত্ব যতদিন ছাত্রদের রাজনৈতিক লাঠি হিসেবে ব্যবহারের নীতি পরিহার না করবে, ততদিনে ছাত্র–অঙ্গনে পরিবর্তনের আশা ক্ষীণ। এর মানে এই নয় যে, ছাত্রলীগ বা অন্য কোনো ছাত্র সংগঠন নিজেরা ঘুরে দাঁড়াতে পারে না? নিশ্চয়ই পারে। তারা ঘোষণা করতে পারে– তারা আর হীন রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত হবে না; আদর্শের পতাকা হাতে পথ চলবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা!

আবু সাঈদ খান: লেখক ও মুক্তিযোদ্ধা; উপদেষ্টা সম্পাদক, সমকাল

সোনালী/জেআর