ঢাকা | জুলাই ২৬, ২০২৪ - ২:৩৩ অপরাহ্ন

ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত শিশুর পরিসংখ্যান নেই

  • আপডেট: Saturday, December 17, 2022 - 1:10 pm

অনলাইন ডেস্ক: ডবলমুরিং থানার তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী মো. শাহেদ (২৬)। শৈশবে সড়ক-ফুটপাতে ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবনধারণ করতো।

আগ্রাবাদ পানওয়ালা পাড়া এলাকায় পরিচিত ‘ভিখারি শাহেদ’ নামে। ভিক্ষাবৃত্তি করতে গিয়েই মাদক বিক্রেতাদের সঙ্গে তার সখ্যতা।

যুক্ত হয় মাদক পাচারে। কিশোর বয়সে ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে শুরু করে ইয়াবার কারবার। গঠন করে কিশোর গ্রুপ। তার ব্যক্তিগত কর্মচারিরা ছিল শৈশব-কৈশোরের ভিক্ষাবৃত্তির সহযোগী।

বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে ভিক্ষাবৃত্তির জন্য চট্টগ্রাম থেকে কুলাউড়া নিয়ে যাওয়া হয়েছিল রাহাত ও সুরমা নামের দুই শিশুকে। পরে তাদের মারধর করা হয়। কাউকে কিছু বললে মেরে ফেলা হবে বলেও হুমকি দেয় এক নারী।

ভাই রাহাতকে আটকে রাখা হয়। আর সুরমাকে বলা হয়, ভিক্ষা করে এনে না দিলে রাহাতকে মেরে ফেলা হবে। কুলাউড়া রেল স্টেশনের প্লাটফর্ম থেকে তাদের উদ্ধার করে রেলওয়ে থানা পুলিশ।

পাহাড়তলী থানাধীন ফইল্যাতলী এলাকা থেকে অপহৃত ৫ মাস বয়সী এক শিশুকে উদ্ধার করেছিল ঢাকার বিমানবন্দর থানা পুলিশ। এসময় আয়েশা আক্তার (২০) নামের এক নারীকে গ্রেফতার করা হয়। শিশুটিকে চট্টগ্রাম থেকে অপহরণ করে নিয়ে ঢাকায় ওই নারী ভিক্ষাবৃত্তি করছিল বলে পুলিশ জানিয়েছে।

ভিক্ষা করতে বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে যেতেন পুতুল বেগম (৪০) ও তার মেয়ে নারমিন (১৮)। বাড়ির মানুষ ভিক্ষা দিতে যখন ভেতরে যেতেন, সর্বোচ্চ ২০ থেকে ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে ঘর থেকে জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়ে যেতেন তারা। এমন অভিনব পন্থায় চুরি করতে গিয়ে ডবলমুরিং থানাধীন মৌলভীপাড়ার কামার গলি থেকে গ্রেফতার হন মা ও মেয়ে।

সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত নারী হোসনে আরা বেগম। নগরের প্রবর্তক মোড় বদনা শাহ মাজারে দুই সন্তানকে নিয়ে তিনি করতেন ভিক্ষা। ১১ বছরের মেয়ের পায়ে পলিথিন প্যাঁচিয়ে পুড়িয়ে ক্ষত করে দিয়েছিলেন বেশি ভিক্ষা পাওয়ার আশায়।

সেই সঙ্গে শিখিয়েছিলেন শারীরিক প্রতিবন্ধী সাজার অভিনয়। ভিক্ষার টাকায় তিনি খেলতেন লুডু। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে মেয়েকে এক বাসায় গৃহপরিচারিকা হিসেবে পাঠান। পরে আবার ভিক্ষা করার জন্য নিয়ে আসতে চাইলে মেয়েটি আর মায়ের কাছে ফিরতে চায়নি।

এতে ক্ষুব্ধ হয়ে হোসনে আরা বেগম গত ২৭ এপ্রিল নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এ তার মেয়েকে অপহরণের অভিযোগে মামলা করেন আশ্রয়দাতা রাশেদুল আলম ও তার স্ত্রী ফারজানা আলী চৌধুরীর বিরুদ্ধে। এ মামলা তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) জানতে পারে এসব তথ্য। মায়ের জিম্মায় যেতে রাজি না হওয়ায় আদালতের নির্দেশে মেয়েকে বর্তমানে ফরহাদাবাদ সেফ হোমে রাখা হয়েছে।

ফরহাদাবাদ সেফ হোমের উপ-তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ আলমগীর জানান, শিশুটির বাম পায়ে ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। সে মায়ের কাছে যেতে চায় না। আর সমাজসেবা অধিদফতর চট্টগ্রামের উপ-পরিচালক ফরিদুল আলম বলছেন, ভিক্ষুক পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান কর্মসূচির আওতায় ওই নারীকে কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।

শিশু আইন ২০১৩ অনুসারে, কোনও ব্যক্তি যদি শিশুকে ভিক্ষার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন বা কোনও শিশুর দ্বারা ভিক্ষা করান অথবা শিশুর হেফাজত, তত্ত্বাবধান বা দেখাশোনায় নিয়োজিত কোনও ব্যক্তি শিশুকে ভিক্ষার উদ্দেশ্যে নিয়োগদান করেন, তাহলে সেটা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ অপরাধের জন্য ওই ব্যক্তি অনধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ড, অনধিক এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা বলছেন, শিশুদের ভিক্ষা বন্ধে আইন থাকলেও বাস্তব প্রয়োগ নেই। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে প্রকাশ্যে শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। একদিকে যেমন শিশুকে বিকলাঙ্গ করে তার ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে, তেমনি সুস্থ শিশুকে ভিক্ষার কাজে ব্যবহার করার কারণে তাকে ধীরে ধীরে পরনির্ভরশীল জীবনের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এখান থেকে অনেক শিশু দ্রুতই অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে। এসব শিশুই পরবর্তী সময়ে মাদকদ্রব্য গ্রহণ ও বহনে জড়াচ্ছে।

চট্টগ্রাম-৪ আসনের এমপি দিদারুল আলমের প্রশ্নের জবাবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রী মো. নুরুজ্জামান আহমেদ সংসদে জানান, বাংলাদেশে ভিক্ষুকের সংখ্যা নির্ধারণের জন্য সমন্বিতভাবে কোনও জরিপ পরিচালিত হয়নি। তবে জেলা পর্যায়ের জেলা প্রশাসক এবং জেলা সমাজসেবা অফিসের উপ-পরিচালকের কার্যালয়ের জরিপ অনুযায়ী সারাদেশে ভিক্ষুকের সংখ্যা ২ লাখ ৫০ হাজার।

জানা গেছে, ২০১১ সালে ভিক্ষুক জরিপ করা হয়, তথ্য সংগ্রহ করা হয় ১০ হাজার ভিক্ষুকের। এদের মধ্যে বিভিন্ন জেলায় পুনর্বাসনের জন্য নির্বাচিত করা হয় ২ হাজার ভিক্ষুককে। ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার অফিসের উদ্যোগে বিভাগের সকল জেলা ও উপজেলাকে ‘ভিক্ষুকমুক্ত’ করতে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছিল।

সমাজসেবা অধিদফতর সূত্র জানায়, ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য সরকারের রাজস্ব খাতের অর্থায়নে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ‘ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান’ শীর্ষক কর্মসূচি গ্রহণ করে। ২০১০ সালের আগস্ট থেকে কার্যক্রম শুরু হয়।

২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো দেশের ৫৮টি জেলায় ভিক্ষুক পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থানের নিমিত্তে অর্থ প্রেরণ করা হয়। সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ হাজার ৬৮০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এতে উপকারভোগী ৩ হাজার জন। ৩৭টি জেলায় অর্থ প্রেরণ এবং ১৬টি সেমিপাকা আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে ভিক্ষুকদের জন্য।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রেপ পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত ৭ হাজার ভিক্ষুকের বেশিরভাগই মহিলা ও শিশু। এদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা প্রায় ১ হাজার। সার্ভিসেস ফর চিলড্রেন অ্যাট রিস্ক (স্কার) প্রকল্পের মাধ্যমে সাতটি বিভাগীয় শহরে সাতটি কেন্দ্রের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুদের নিয়ে কাজ করা হয়। এই প্রকল্পে জড়িত কর্মকর্তারা দিতে পারেননি ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত শিশুর পরিসংখ্যান।

নগরের ১৬টি স্থানে ভিক্ষুকদের আনাগোনা বেশি। মাজারকেন্দ্রিক ভিক্ষুকরা সকাল হতেই নেমে যায় এ কাজে। পাশাপাশি কালুরঘাট, রেল স্টেশন, নতুন ব্রিজ, বাস টার্মিনাল, পতেঙ্গা সৈকত, আগ্রাবাদ, ষোলশহর, মুরাদপুর, নিউমার্কেট এলাকায় দল বেঁধে তারা ভিক্ষা করে। এতে শিশুদেরও ব্যবহার করা হচ্ছে। বিভিন্ন মেলায় রোগাক্রান্ত শিশুকে শুইয়ে রেখে চলে ভিক্ষাবৃত্তি। রমজান মাসে বেড়ে যায় মৌসুমি ভিক্ষুকদের উৎপাত।

ভিক্ষুকদের সিন্ডিকেটও আছে। তারা সুস্থ মানুষকেও অসুস্থ সাজিয়ে কিংবা কখনও কখনও অঙ্গহানি ও বিকৃতির মাধ্যমে ভিক্ষাবৃত্তিতে বাধ্য করছে। সেই সঙ্গে কোনও পরিবারের মা কিংবা বাবা যদি ভিক্ষুক হয়, সেই পরিবারের শিশুসন্তানকেও ভিক্ষাবৃত্তিতে নামানো হচ্ছে। এমনও পরিবার আছে, যারা সুস্থ-স্বাভাবিক হয়েও ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছে। আয়ের সহজ পথ হিসাবে বেছে নেওয়া হচ্ছে ভিক্ষাবৃত্তি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভিক্ষুক পুনর্বাসনের জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা দরকার। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ভিক্ষুকদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে নেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেসি সহায়তাও প্রয়োজন।

সোনালী/জেআর