৭০তম জন্মদিনে রাজনীতির ৫০ বছর
![](https://sonalisangbad.com/wp-content/uploads/2022/11/Untitled-2-copy.jpg)
স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলে হোসেন বাদশা এমপি’র ৭০তম জন্মবার্ষিকী ও বর্ণাঢ্য রাজনীতির ৫০ বছর পূর্তি আজ। দীর্ঘদিন ধরে রাজশাহীর মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য লড়ে যাচ্ছেন তিনি। কিশোর বয়সে রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে মানুষের জীবনমান উন্নয়নের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। দেখতে দেখতে রাজনৈতিক জীবনের ৫০ বছর পার করেছেন। রাজশাহী-২ (সদর) আসনের সংসদ হয়ে আছেন ১৪ বছর থেকে। এই ১৪ বছরে করেছেন রাজশাহীর ব্যাপক উন্নয়ন। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা থেকে বাদ যায়নি মসজিদ-মন্দিরও। রাজনৈতিক জীবনের ৫০ বছর উপলক্ষে রাজশাহীবাসীর পক্ষ থেকে দেয়া হবে নাগরিক সংবর্ধনা। আজ শনিবার বিকাল ৩ টায় নগরীর শিল্পকলা অ্যাকাডেমিতে এই সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছে। এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে সংর্বধনা দেবেন রাজশাহীর বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ।
ফজলে হোসেন বাদশা রাজশাহীবাসীর কাছে ‘বাদশা ভাই’ নামে বেশি পরিচিত। তিনি ১৯৫২ সালের ১৫ অক্টোবর রাজশাহী মহানগরীর হড়গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা খন্দকার আশরাফ হোসেন রাজশাহী জজকোর্টের খ্যাতনামা আইনজীবী ছিলেন। তিনি রাজশাহী বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির দায়িত্ব পালনসহ বিভিন্ন ধরনের সমাজসেবামূলক ভূমিকা পালন করেন। মা দিলারা বেগম গৃহপরিচালনার পাশাপাশি নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে সামাজিক দায়িত্ব পালনে সচেতন ছিলেন। নয় ভাই-বোনের মধ্যে ফজলে হোসেন বাদশা তৃতীয়। তার জন্ম, শৈশব, তারুণ্য, বর্তমান রাজশাহী মহানগরীতেই। বর্ণমালা শেখা শুরু করেন মা ও বোনের কাছে। ১৯৬৭ সালে তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৭০ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অনার্সসহ অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ও এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে বাদশা তুখোড় ছাত্রনেতা হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। শুরু থেকে তিনি প্রগতিশীল বামধারার রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) সদস্য পদ গ্রহণ করেন। এর দুই বছর পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বাদশা একজন সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় তিনি রাজশাহী মহানগরীর পশ্চিমাঞ্চলে ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করেন। এরপর সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার উদ্দেশ্যে প্রথমে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা মেলাঘর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যোগদান করেন। পরে মুর্শিদাবাদ জেলার পানিপিয়া ক্যাম্পে আসেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার জন্য তিনি কিছুদিন ধুলাউড়া ক্যাম্পেও ছিলেন।
দেশ স্বাধীনের পর প্রগতিশীল ছাত্রসমাজকে সংগঠিত করেন ও ছাত্রদের দাবি আদায়ে বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠেন। এ জন্য তাকে বার বার কারাবরণও করতে হয়। ক্রমশ তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী মহানগরীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে স্বাধীনতাবিরোধী ও জঙ্গিবাদবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। সেসময় তিনি আন্দোলন করে কারাবন্দি হন। বের হয়ে ১৯৮০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) এর ভিপি (ভাইস প্রেসিডেন্ট) নির্বাচিত হন। ওই বছরের ৬ ডিসেম্বর তিনি বাংলাদেশ বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী নামে নতুন একটি ছাত্র সংগঠন গড়ে তুলতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। তিনি সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হয়েছিলেন। পরবর্তীতে সংগঠনটির নাম থেকে বিপ্লবী শব্দটি বিলুপ্তি করে নামকরণ হয় বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী। ছাত্রজীবন শেষের পর যুব সংগঠনের নেতৃত্বে আসেন। তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন ‘বাংলাদেশ যুবমৈত্রী’ নামের নতুন সংগঠন এবং সভাপতি নির্বাচিত হন। ছাত্রদের দাবি আদায়ের পাশাপাশি তাকে শ্রমিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে দেখা যায়। ফলে এক সময় রাজশাহী মহানগরীর রিকশাচালকদের প্রয়োজনের বন্ধু হয়ে ওঠেন। ১৯৭৭ সালে রিকশা শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে তাদের সংগঠিত করেন। কৃষি-কারখানার শ্রমিকদের অধিকার আদায়েও বাদশা সহযোগী কর্মীর ভূমিকা পালন করেন।
আদিবাসীদের সামাজিক জীবনধারার উন্নয়ন এবং তাদের প্রতি নির্যাতনের প্রতিবাদে বাদশা সবসময়ই সক্রিয় থেকেছেন। ১৯৯৩ সালে আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের উদ্দেশ্যে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ গঠনে তিনি মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন এ পরিষদের প্রধান উপদেষ্টা। বরেন্দ্র অঞ্চলে তার প্রচেষ্টায় দুটি আদিবাসী স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৮২ সালে ২৩ মার্চ দেশে সামরিক শাসন শুরু হলে বাদশা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আন্দোলন চলে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর গণঅভ্যূত্থান পর্যন্ত। এ অভ্যূত্থান ৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন নামে পরিচিত। ফজলে হোসেন বাদশা আন্দোলনের সংগ্রামী সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। এ জন্য নয় বছরের আন্দোলনে তাকে বার বার কারাবন্দি হতে হয়। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ছাত্রনেতা থেকে বর্তমান পর্যন্ত ছাত্রের দাবি, গণতন্ত্র, আদিবাসী অধিকার, শ্রমিক নির্যাতন বন্ধকরণসহ বিভিন্ন আন্দোলনে সক্রিয় আছেন।
বাদশার সংগ্রামমুখর রাজনৈতিক জীবনে অনেকবারই ঢাকা ও রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ হয়েছেন। বন্দি অবস্থাতেও তিনি নির্যাতনের শিকার হন। আবার তাকে বন্দিদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়ে উঠতে দেখা যায়। রাজশাহীতে কারাবাসের সময় বন্দিদের উপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি আন্দোলন গড়ে তোলেন। ওই আন্দোলন দমনে গুলি চালালে তিনজন বন্দি নিহত হন। এতে আন্দোলন আরও গতিশীল হয়ে উঠে ও এক পর্যায়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কারাগারে আসেন। তিনি বাদশাসহ আন্দোলনরত নেতাদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে বন্দিদের বেশ কিছু দাবি মেনে নেন। তার প্রচেষ্টায় কারা অভ্যন্তরে ওই তিন মৃত ব্যক্তির স্মরণে একটি শহিদমিনারও নির্মিত হয়। ১৯৮৩ সালে ঢাকায় সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দানের কারণে ডিসেম্বরে সামরিক বাহিনী তাকে গ্রেপ্তার করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। ক্যান্টনমেন্টে নয় দিন ও নয় রাত তার উপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়।
তিনি ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ সালে জাতীয় নির্বাচনে রাজশাহী-২ (পবা-বোয়ালিয়া) আসনে সংসদ সদস্য পদে এবং ২০০২ সালে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ২০০৮ সালে রাজশাহী মহানগরী বোয়ালিয়া নামে রাজশাহী-২ আসন নির্ধারিত হয়। এই আসনে ফজলে হোসেন বাদশা ২০০৮ সালে ২৯ ডিসেম্বর ১৪ দলীয় জোট প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে জাতীয় সংসদে রাজশাহীবাসীর উন্নয়নের জন্য কথা বলতে শুরু করেন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি পুনরায় তিনি একই আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে রাজশাহীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে দৃষ্টান্ত স্থাপনে সক্ষম হন। মহানগরীর উপশহরে অবস্থিত শহিদ এএইচএম কামারুজ্জান ডিগ্রি কলেজকে সরকারিকরণে তিনি মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। এ কলেজের অবকাঠামো উন্নয়নেও ভূমিকা রাখেন। তার প্রচেষ্টায় রাজশাহী কলেজে পুনরায় উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণি সংযোজিত হয়।
২০১১ সালের ডিসেম্বরে তিনি সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় অংশগ্রহণ করে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে বন্ধ হয়ে যাওয়া রাজশাহী রেশম কারখানা ২০১৭ সালে পূনরায় চালু করতে তিনি মূল ভূমিকা পালন করেন। এছাড়া বন্ধ হয়ে যাওয়া শাহ মখদুম বিমানবন্দর ২০১৫ সালে পূনরায় চালুর ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা ছিল মূখ্য। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বর্তমানে রাজশাহী-ঢাকা রুটে তিনটি বিমান চলছে। আগামী ১৭ নভেম্বর রাজশাহী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিমান চালু হতে যাচ্ছে।