৯ মাসে ৪০৪ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, ৭৫ শতাংশ মানসিক সমস্যায়
অনলরাইন ডেস্ক: চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর (৯ মাস) ৪০৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। যার মধ্যে নারী শিক্ষার্থী রয়েছেন ২৪২ জন। এছাড়া কোভিড মহামারী পরবর্তী সময়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ৭৫ শতাংশের বেশি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন, যে সমস্যা থেকে আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছেন তাদের অনেকে। এমন দাবি করেছে আঁচল ফাউন্ডেশন।
আঁচল ফাউন্ডেশনের করা এক জরিপ থেকে জানা যায়, দেশের ৩৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ৪৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ মাদরাসা ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১ হাজার ৬৪০ জন শিক্ষার্থীর উপর সমীক্ষা চালিয়ে সংগঠনটি দেখতে পেয়েছে, ৩৪ দশমিক ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর পড়াশোনা সংক্রান্ত সমস্যা থেকে বাঁচতে আত্মহত্যার পরিকল্পনা করছিলেন।
বাংলাদেশে ২০২০ সালের মার্চ থেকে শুরু হওয়া কোভিড মহামারীর কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সেশনজট ও পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে হতাশাকে শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন এ সংশ্লিষ্ট গবেষকরা।
পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক চাপেও পড়াশোনায় অনীহা তৈরি, অভিভাবকদের চাপ, কোভিডে মনস্তাত্বিক পরিবর্তনকে শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
শনিবার করোনা পরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর একাডেমিক চাপের প্রভাব এবং তাদের আত্মহত্যার প্রবণতা’ শিরোনাম শীর্ষক এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এই সমীক্ষার প্রতিবেদন তুলে ধরে আঁচল ফাউন্ডেশন। সম্মেলনে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন সংগঠনের গবেষক ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক আব্দুল ওহাব।
এ সময় আরও যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক (অব.) ড. মো. মাহমুদুর রহমান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা অনুষদের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহনেওয়াজ খান চন্দন এবং আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ।
ওহাব জানান, গত ৯ মাসে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আত্মহত্যা করেছেন ৪০৪ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৭ শিক্ষার্থী, স্কুলের ২১৯, মাদরাসার ৪৪ জন এবং কলেজ পড়ুয়া ৮৪ জন। আত্মহননকারীদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থী ২৪২ জন এবং পুরুষ শিক্ষার্থী ১৬২ জন।
শিক্ষার্থীদের ওপর একাডেমিক চাপ তাদের আত্মহত্যার পেছনে কতটুকু দায়ী এবং অন্যান্য কী কী কারণ জড়িত, তা জানার লক্ষ্যেই এ গবেষণা জরিপ পরিচালিত হয় বলে জানান ওহাব।
সংগঠনটি জানায়, জরিপে মানসিক সুস্থতা বিষয়ক বেশ কয়েকটি নিয়ামক নিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চাওয়া হলে উত্তরে আসে ‘উদ্বেগজনক’ কিছু তথ্য। মোট অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৫৭.৯৯ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন কোভিড মহামিারী পরবর্তী সময়ে তাদের নিজস্ব শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অতিরিক্ত ভয় ও উদ্বেগে তারা জর্জরিত। পাশাপাশি দৈনন্দিন আচার-আচরণ ও ব্যবহারে পরিবর্তনও এসেছে শিক্ষার্থীদের জীবনে। যেমন, মন খারাপ হওয়া, হঠাৎ ক্লান্তিসহ নানা বিষয় তাদের শিক্ষাজীবনে প্রভাব ফেলেছে বলে জানায় ৮০.৭৯ শতাংশ শিক্ষার্থী।
দৈনন্দিন জীবন-যাপনের অংশ হয়ে যাওয়া ডিজিটাল ডিভাইসগুলোর মধ্যে মোবাইল, ল্যাপটপ, ডেস্কটপের উপরে অতিরিক্ত আসক্তি ও নির্ভরতা শিক্ষাজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে জানিয়েছেন ৭০.৭৩ শতাংশ শিক্ষার্থী। আবার মানসিকসমস্যা জনিত কারণে নিত্যদিনের ঘুমের অভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে। যেমন অতিরিক্ত ঘুম অথবা নিদ্রাহীনতায় ৭১.৭১ শতাংশ শিক্ষার্থী ভুগছেন। যা লেখাপড়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
ব্যক্তিত্বের পরিবর্তনের কথাও জানান জরিপে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা। যেমন হঠাৎ চুপচাপ হয়ে যাওয়া বা অনেককিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া, বর্হিমুখী (এক্সট্রোভার্ট) কিংবা আত্মকেন্দ্রীক (ইন্ট্রোভার্ট) হয়ে উঠার প্রবণতাও তাকে শিক্ষাজীবনকে ব্যাহত করছে জানায় ৪৭.৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী।
ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক কিংবা রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নিয়ে শিক্ষার্থীদের পাশের দাঁড়ানোর কথা তুলে ধরে ড. মোহাম্মদ মাহমুদুর রহমান বলেন, আমাদের রিপোর্ট হয় কে মারা গেলো তা নিয়ে। কিন্তু কী কারণে মারা গেলো তা জানা যায় না। সুইসাইড প্রিভেনশনের ক্ষেত্রে কিন্তু এক একটি মৃত্যু থেকে আমাদের শিক্ষণীয় আছে। তার আশেপাশের যারা কাছের মানুষ তাদের কিন্তু এখানে একটা নিবিড় ভূমিকা থাকা দরকার। আমরা তাদের প্রশিক্ষণ দিতে পারি যে, কী কী লক্ষণ দেখে জানা যাবে, একটি মানুষ আত্মহত্যার দিকে ঝুকছে।
শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির জন্য দায়ী যে সমস্যাগুলো জরিপে উঠেছে এসেছে, তা মোটামুটি চার ধরনের। সেগুলো হলো- একাডেমিক চাপ, আর্থিক সংকট ও ক্যারিয়ার দুশ্চিন্তা এবং শিক্ষার সামগ্রিক পরিবেশ। আঁচল ফাউন্ডেশন সে বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সমস্যা সমাধানে কয়েকটি প্রস্তাব তুলে ধরে।
সংস্থাটি তাদের প্রস্তাবনায় বলছে, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বাভাবিক ও ইনফরমাল সম্পর্ক তৈরি করা, অতিরিক্ত সিলেবাস কমিয়ে যথাসময়ে পরীক্ষা সম্পন্ন করে সেশনজটমুক্ত করা, পড়াশোনাকে আনন্দময় ও বাস্তবমুখী করা, প্রথাগত সিলেবাসের পরিবর্তে চাকরি বাজারের উপযোগী সিলেবাস প্রণয়ন, শিক্ষাঋণ চালু করা, স্ব স্ব ক্যাম্পাসে খণ্ডকালীন চাকরির ব্যবস্থা করা, ক্যারিয়ার গঠনে পরামর্শ ও সহায়তা পেতে বিভাগের উদ্যোগে অ্যালামনাইদের সঙ্গে যোগাযোগ জোরদার করা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ এবং মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে বিভিন্ন সভা সেমিনার আয়োজন করা।
শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যারিয়ার কেন্দ্রিক ভাবনায় সবচেয়ে এগিয়ে রাখছে সরকারি চাকরিকে। ৩৮.৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থী সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত হতে চান। আবার ৩১.১০ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনা শেষ করে বিদেশে ক্যারিয়ার গড়তে চান। বেসরকারি চাকরি করতে আগ্রহী মাত্র ৮.৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী।
অন্যদিকে ব্যবসা ও ফ্রিল্যান্সিং এর মাধ্যমে নিজের কর্মসংস্থান গড়তে চান ১০.০৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থীর সরকারী চাকুরী পাবার ঝোঁক কিছুটা ভীতি জাগানিয়া। কারণ এদের মাঝে যারা সরকারি চাকুরী পেতে ব্যর্থ হবেন তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারেন।
আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ধরণের মানসিক সমস্যা এবং আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে পড়া নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। যে সমস্যাগুলো নিয়ে তারা ভুগে থাকেন তাদের অনেকগুলোরই চাইলে সমাধান করা যায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পড়াশুনার সঠিক পরিবেশ নিশ্চিত করা, শিক্ষকদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি, মন খুলে কথা বলার মত সামাজিক পরিবেশ তৈরি ইত্যাদির মাধ্যমেও তাদের এই সমস্যা মোকাবেলা করা সম্ভব।
শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির জন্য দায়ী যে সমস্যাগুলো বিবেচনায় আঁচল ফাউন্ডেশন সমস্যা সমাধানে বেশ কিছু প্রস্তাব পেশ করেছে। সেগুলো হলো- শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে স্বাভাবিক ও ইনফরমাল সম্পর্ক তৈরি করা।
অতিরিক্ত সিলেবাস কমিয়ে যথাসময়ে পরীক্ষা সম্পন্ন করে সেশনজট মুক্ত করা।
পড়াশোনাকে আনন্দময় ও বাস্তবমুখী করা।
প্রথাগত সিলেবাসের পরিবর্তে চাকুরী বাজারের উপযোগী সিলেবাস প্রণয়ন।
শিক্ষাঋণ চালু করা।
স্ব স্ব ক্যাম্পাসে খন্ডকালীন চাকুরীর ব্যবস্থা করা।
ক্যারিয়ার গঠনে পরামর্শ ও সহায়তা পেতে বিভাগের উদ্যোগে অ্যালামনাইদের সাথে যোগাযোগ জোরদার করা।
জরুরি ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ।
মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে বিভিন্ন সভা সেমিনার আয়োজন করা।
শিক্ষকদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেয়া।