এই ভুল পথে কেউ যেনো পা না বাড়ায়: বাড়ি ফেরা নিলয়
অনলাইন ডেস্ক: জঙ্গি সম্পৃক্ততায় কুমিল্লাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে বাড়ি ছেড়ে যাওয়া ৪ জনসহ মোট ৭ জনকে বুধবার দিবাগত রাত পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
গ্রেপ্তাররা হলেন, হোসাইন আহম্মদ, মো. নেসার উদ্দিন ওরফে উমায়ের, বণি আমিন, ইমতিয়াজ আহমেদ রিফাত, মো. হাসিবুল ইসলাম, রোমান শিকদার ও মো. সাবিদ।
তাদের কাছ থেকে নব্য জঙ্গি সংগঠনের তিন ধরণের প্রচারপত্র, বিস্ফোরক তৈরির নির্দেশিকা সম্বলিত পুস্তিকা, নব্য জঙ্গি সংগঠনের কর্মপদ্ধতি (খসড়া মানহায), উগ্রবাদী বই ‘’নেদায়ে তাওহীদের’’ ৪ কপি, জিহাদী উগ্রবাদ ভিডিও সম্বলিত একটি ট্যাব উদ্ধার করা হয়।
গত ২৩ আগস্ট কুমিল্লা সদর এলাকা হতে ৮ তরুণের নিখোঁজের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় ২৫ আগস্ট কুমিল্লার কোতয়ালী থানায় সাধারণ ডায়েরি হয়। র্যাব নিখোঁজের ঘটনায় ভুক্তভোগীদের উদ্ধার ও জড়িতদের গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে।
তদন্তকালে প্রাথমিকভাবে র্যাব জানতে পারে, জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা বাড়ি ছেড়েছে। ইতোমধ্যে গত সেপ্টেম্বরে ঘর ছাড়ার প্রস্তুতিকালে ৪ জন তরুণকে হেফাজতে নিয়ে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয় র্যাব।
এদিকে কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ ৮ তরুণের মধ্যে শারতাজ ইসলাম নিলয় (২২) নামের একজন গত ১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কল্যাণপুরের নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন। পরে তাকে পরিবারের হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করে র্যাব। এরপর তার দেয়া তথ্যে সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তার বাড়িছাড়া সাতজনের বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে র্যাব। এ সময় নিলয় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, পরিবার ছেড়ে চলে যেতে হবে— তা কোনোভাবে মানতে পারিনি। যাওয়ার পরই তা বুঝতে পারি।
তিনি জানান, খালাতো ভাইয়ের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে অন্য তরুণদের সঙ্গে ঘর ছেড়েছিলেন। তাকে প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বাইরে উদ্বুদ্ধ করা হয়। তবে পটুয়াখালিতে যাওয়ার পর তিনি বুঝতে পারেন জঙ্গিবাদ ভুল পথ।
নিলয় বলেন, পরিবার ছেড়ে হিজরতের কথাটা যখন আসে তখন থেকে এটা আমি মেনে নিতে পারিনি। অনেকটা বাধ্য হয়ে আমি সেখান থেকে বের হবার চেষ্টা করি। সুযোগ বুঝে আমি বাসায় ফিরে আসি।
মানুষকে কতল করতে হবে, কথিত তাগুতকে উৎখাত বা সশস্ত্র হামলা- জঙ্গিদের এসব কার্যক্রম বিষয়ে তিনি বলেন, সশস্ত্র প্রস্তুতির কথা বারবার শুনেছি। কিন্তু আমি সেই স্টেজ (পর্যায়) পর্যন্ত যেতে পারিনি। তার আগেই ভুল বুঝতে পেরে ফিরে আসি।
নিলয় বলেন, আমি চার-পাঁচ দিন ছিলাম। এর মধ্যেই বুঝতে পারি এটি ভুল পথ। আসলেই এটি ভুল পথ। এই ভুল পথে আর যেনো কেউ পা না বাড়ায়।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের মূখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গত ২৩ আগস্ট সকাল ১০টায় নিলয়সহ পাঁচ তরুণ নিজ বাড়ি থেকে বের হয়ে কুমিল্লা টাউন হল এলাকায় যান। পরে সোহেলের নির্দেশনায় তারা দুই ভাগ হয়ে লাকসাম রেল ক্রসিংয়ের কাছে হাউজিং স্টেট এলাকার উদ্দেশে যাত্রা করেন। নিলয়, সামি ও নিহাল একত্রে যাত্রা করেন। তবে তারা ভুলবশত চাঁদপুর শহর এলাকায় চলে যায়। তারা ভুল বুঝতে পেরে রাত্রিযাপনের উদ্দেশ্যে চাঁদপুরের একটি মসজিদে অবস্থান করলে কর্তব্যরত পুলিশ সন্দেহজনক আচরণের কারণে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরে পুলিশ তাদের পাশের একটি হোটেলে রেখে যায় এবং পরদিন বাসায় চলে যেতে নির্দেশ দেয়।
তারা রাতে হোটেল থেকে কৌশলে পালিয়ে তাদের পূর্বনির্ধারিত স্থানে গেলে সোহেল ও অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি তাদের লাকসামের একটি বাড়িতে নিয়ে যায়। ওই বাড়িতে আগে থেকেই অবশিষ্ট তিনজন অবস্থান করছিলেন।
পরে নিলয়, নিহাল, সামি ও শিথিলকে কুমিল্লা শহরের একটি মাদ্রাসার মালিক নিয়ামত উল্লাহর কাছে পৌঁছে দেন সোহেল। নিয়ামত উল্লাহর তত্ত্বাবধানে একদিন থাকার পর সোহেল চারজনকে নিয়ে ঢাকায় আসেন এবং নিহাল, সামি ও শিথিলকে অজ্ঞাত ব্যক্তির কাছে বুঝিয়ে দিয়ে নিলয়কে পটুয়াখালীর একটি লঞ্চের টিকিট কেটে পটুয়াখালীতে পাঠান।
গ্রেপ্তার বণি আমিন পটুয়াখালীতে নিলয়কে স্থানীয় এক মাদ্রাসায় নিয়ে যান এবং গ্রেপ্তার হুসাইন ও নেছার ওরফে উমায়েরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। বণি আমিন নিলয়কে তিনদিন তার বাসায় রাখেন। তার বাসায় অতিথি আসায় পরে নিলয়কে হোসাইনের মাদ্রাসায় রেখে আসেন। নিলয় মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে গত ১ সেপ্টেম্বর কল্যাণপুরে নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন।
নিলয়ের দেয়া তথ্যমতে বনি আমিনকে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক এলাকা হতে গ্রেপ্তার করে র্যাব। বণি আমিনের তথ্য মতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক এলাকা হতে নেছার উদ্দিনকে গ্রেপ্তর করা হয়। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে হুসাইন আহমদ, রিফাত, হাসিব, রোমান শিকদার ও সাবিতকে নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকা থেকে গ্রেপ্তর করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেপ্তার হাসিব ও রিফাত ১ বছর আগে কুমিল্লার কোবা মসজিদের ইমাম হাবিবুল্লাহর কাছে সংগঠনের বিষয়ে প্রাথমিকভাবে ধারণা পায়। পরে হাবিবুল্লাহ তাদের উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ করে ফাহিম ওরফে হাঞ্জালার কাছে নিয়ে যায়। ফাহিম তাদেরকে কুমিল্লার বিভিন্ন মসজিদে নিয়ে গিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে মুসলমানদের উপর নির্যাতনসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাত্ত্বিক জ্ঞান প্রদান করতো ও ভিডিও দেখাতো।
এইভাবে তাদের সশস্ত্র হামলার প্রস্তুতি নিতে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয়ে আগ্রহী করে তোলে।
গ্রেপ্তার রোমান স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য গত ৪০ দিন আগে নিরুদ্দেশ হয় এবং গ্রেপ্তার সাবিত ২ মাস আগে পটুয়াখালী থেকে নিখোঁজ হয়।
র্যাব জানতে পেরেছে, সোহেল নামের একজন ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ হওয়া তরুণদের সশস্ত্র হামলার প্রস্তুতির জন্য প্রশিক্ষণ নিতে পটুয়াখালী ও ভোলাসহ বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হয়। নিরুদ্দেশ হওয়া তরুণদেরকে বিভিন্ন সেইফ হাউজে রেখে পটুয়াখালী এলাকার সিরাজ ওরফে রবি নামের একজন ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে পটুয়াখালী ও ভোলার বিভিন্ন চর এলাকায় সশস্ত্র হামলা, বোমা তৈরি, শারীরিক কসরত ও জঙ্গিবাদ বিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদান করা হতো।