কলকাতা বন্দরকে টেক্কা দেবে মোংলা
অনলাইন ডেস্ক: সরকারের গৃহীত কিছু বড় উদ্যোগ বাস্তবায়নের ফলে আন্তর্জাতিক জাহাজের একটি সমৃদ্ধ কেন্দ্রে পরিণত হতে যাচ্ছে মোংলা বন্দর। বন্দর কর্তৃপক্ষ আশা করছে, বন্দরের চ্যানেলগুলোর ড্রেজিং এবং জেটির কাজ সম্পূর্ণ হলে ২০২৪ সালের মধ্যে বন্দরটি কলকাতা বন্দরের প্রতিযোগী হয়ে উঠবে।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ মুসা এ বিষয়ে বলেন, মোংলা বন্দর ২০২৪ সালের মধ্যে তার পরিষেবা বাড়াতে পারবে। কারণ, এই সময়ের মধ্যে অভ্যন্তরীণ ড্রেজিং, জেটির উন্নয়ন এবং বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনা সম্পন্ন হবে। আর এই সময়ের মধ্যে জেটিগুলোর আধুনিকীকরণ করাও শেষ হবে। ফলে বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতুর ফলে বন্দর ব্যবহারকারী বিদেশি জাহাজগুলোর পণ্য খুব সহজেই দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিবহনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
প্রসঙ্গত, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের ফলে ঢাকা এবং মোংলা বন্দরের মধ্যে দূরত্ব কমেছে ১৭০ কিলোমিটার, যা ঢাকার সঙ্গে দেশের বৃহত্তম বন্দর চট্টগ্রামের দূরত্বের চেয়ে ৯০ কিলোমিটার কম। ২৮ জুলাই সকালে মোংলা বন্দর থেকে বাংলাদেশে উৎপাদিত পোশাকের একটি চালান পোল্যান্ডে পাঠানো হয়। বর্তমানে, বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মাণ প্রকল্পের মেশিনারি পণ্যের প্রথম চালান নিয়ে মোংলা বন্দরে অবস্থান করছে দক্ষিণ কোরিয়ার পতাকাবাহী জাহাজ “এমভি উহিয়ান হোপ”।
জাহাজটি ৬ আগস্ট বিকাল ৪টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেল সেতু নির্মাণ প্রকল্পের জন্য ফ্যাবরিকেটেড স্টিল ট্রাস মেম্বার উইথ লেটারাল ফোর্স সাপোর্ট (প্রজেক্ট কার্গো)-এর প্রথম চালান নিয়ে বন্দরের সাত নম্বর জেটিতে নোঙর করে। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন না হলে দুটি জাহাজকেই চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে হতো।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বড় জাহাজ চলাচলের সুবিধার্থে ব্যাপক ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে মূল চ্যানেলের নাব্যতা সমস্যা সমাধান করা হয়েছে। জেটিকে আরও উন্নত করা হচ্ছে।
এদিকে, খুলনা-মোংলা রেলপথের নির্মাণকাজ প্রায় শেষের দিকে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ বন্দরটি রেল সংযোগের মাধ্যমে ঢাকার সঙ্গে যুক্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (ট্রাফিক) মো. মোস্তফা কামালবলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর মোংলা বন্দর এখন রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয়েছে। ফলে বন্দরের কার্যক্রম বহুগুণ বেড়েছে।
নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করার পর মোংলা বন্দর এখন ধীরে ধীরে বড় একটি হাবে পরিণত হচ্ছে। ড্রেজিং শেষ হলে দুই-এক বছরের মধ্যে বন্দর আরও প্রাণবন্ত হবে। একবার ড্রেজিং সম্পন্ন হলে, কোনো নাব্যতা সমস্যা থাকবে না।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ক্রমবর্ধমান বন্দর
মোংলা বন্দরে ইতোমধ্যে বিদেশি জাহাজের যাতায়াত বেড়েছে। এটি ধীরে ধীরে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের একটি প্রধান প্রবেশদ্বার হয়ে উঠছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের মতে, ২০০৮ সালে ১০ এর নিচে নেমে যাওয়ার পর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতি মাসে আগত জাহাজের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বন্দরের নাব্যতা বাড়াতে এবং বড় জাহাজগুলোর ট্রানজিটের অনুমতি দিতে চ্যানেলের বাইরে প্রায় ১৪০ কিলোমিটার ড্রেজিং করা হয়েছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে ৭১২ কোটি টাকা ব্যয়ে এই ড্রেজিং সম্পন্ন করা হয়। ২০২১ সালের প্রতি মাসে ৭৫টি করে জাহাজ বন্দরে আসে, যা গত পাঁচ বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০১২ সাল থেকে জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ে বন্দরটির বার্ষিক আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ১৭%। একই সময়ের মধ্যে কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে ১৯%। ২০২০-২১ সালে প্রায় ১০.১৯ মিলিয়ন টন মাল পরিবহন করা হয়েছিল, যা পাঁচ বছর আগের তুলনায় দ্বিগুণ।
এছাড়াও বন্দরে পাঁচটি জেটিসহ ২৫টি বার্থিং সুবিধা রয়েছে। যদিও এখনও জেটিগুলোতে পর্যাপ্ত গভীরতা নেই। এখানে সাত মিটার বা তার বেশি উচ্চতা বিশিষ্ট বড় জাহাজের প্রবেশে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ৮.৫ মিটার পর্যন্ত উচ্চতার জাহাজ আকরাম পয়েন্ট এবং হারবাড়িয়া পর্যন্ত পৌঁছতে পারে।
বন্দরের জন্য নেওয়া উদ্যোগ
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ ঢাকা ট্রিবিউনকে জানিয়েছে, পশুর চ্যানেলের ইনার বারে ড্রেজিংয়ের কাজ চলছে। যাতে ৯ মিটারের বেশি উচ্চতার জাহাজগুলো জেটি ব্যবহার করতে পারে। ৭৯৩ কোটি টাকা ব্যায়ে এই ড্রেজিং প্রকল্প ২০২৩ সালের জুন মাসের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ বলেন, ২০২৩ সালে ড্রেজিং শেষ হলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীরা মোংলা বন্দর আরও ভালভাবে ব্যবহার করতে পারবেন।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক মো. মোস্তফা কামাল বলেন, বন্দরের ড্রেজিং সম্পন্ন হলে কনটেইনার কার্গো, বিশেষ করে গার্মেন্টসের চালান বেশি দেখা যাবে। নেপাল এবং ভুটানও তাদের বাহ্যিক বাণিজ্যের জন্য বন্দরটিকে সুবিধাজনক বলে মনে করছে। তারা কলকাতা বন্দরের পরিবর্তে মংলা বন্দর ব্যবহার করতে পারে।
বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মোংলা বন্দরের উন্নয়নে ২০০৯ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ৩৭২.৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৫টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ভিশন-২০৪১-এর আওতায় আরও ৯টি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। ৪৩৩ কোটি টাকার প্রকল্পের আওতায় মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ কার্গো পরিচালনার জন্য ৭৫টি যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম কেনার প্রক্রিয়া প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এছাড়া ৭৬৭ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্পের আওতায় সাগরগামী জাহাজ পরিচালনার জন্য ছয়টি জাহাজ কিনবে।