ঢাকা | জুলাই ২৬, ২০২৪ - ৯:২৫ পূর্বাহ্ন

পদ্মা সেতু নির্মাণে লড়তে হয়েছে গুজবের সঙ্গেও

  • আপডেট: Friday, June 24, 2022 - 8:11 pm

অনলাইন ডেস্ক: গর্বের পদ্মা সেতু আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই সেতু তৈরি হয়েছে অনেক বাধা পেরিয়ে। একদিকে প্রমত্তা পদ্মার অস্বাভাবিক স্রোত এই সেতু নির্মাণকে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে; অন্যদিকে সেতুর অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের ‘না’ ও বিভিন্ন মহলের ষড়যন্ত্র সেতুর নির্মাণযজ্ঞকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছে বারবার। ফলে পদ্মা সেতুর নির্মাণ বাংলাদেশের জন্য এক সম্মান রক্ষার লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।

উত্তাল পদ্মার বুকে চিরে পারাপারের জন্য এতদিন ২১টি জেলার মানুষকে নির্ভর করতে হতো নৌপথের ওপর। ফেরি, স্পিডবোট, নৌকা, ট্রলারযোগে পদ্মা পেরোতে কখনো কখনো পুরো একটা দিন লেগে যেত। তীব্র শীতে, প্রবল বর্ষায়, কালবৈশাখী ঝড়ে, ঈদে মানুষের যাতায়াত হয়ে পড়ত অনিশ্চিত। ছয় ঘণ্টার পথ পেরোতে কখনো কখনো লেগে যেত ২৪ ঘণ্টারও বেশি। মরদেহ পরিবহন, অসুস্থ রোগী কিংবা শিশুদের ভোগান্তি ছিল অবর্ণনীয়।

দীর্ঘ নির্মাণযজ্ঞের মধ্য দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে এই সেতুকে লড়তে হয়েছে গুজবের সঙ্গেও। আর সেই গুজবের বলি হয়ে প্রাণ দিয়েছেন অনেকেই।

গুজব: পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজে মানুষের কাটা মাথা লাগবে
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই তথ্য প্রচার করা হচ্ছিল। এ বিষয়ে ম্যাসেঞ্জারে ইনবক্স করে একে অপরকে সতর্ক করছিলেন নেটিজেনরা। বেশির ভাগ মানুষই না বুঝে এ রকম কুসংস্কারে গা ভাসিয়েছেন। ২০১৯ সালে ‘ছেলেধরা’ গুজবে সারা দেশে ২১টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় প্রাণ হারান পাঁচজন।

২০১৯ সালের মার্চ মাস থেকে মূলত ব্যাপকভাবে এই গুজব ছড়িয়ে পড়ে। গুজবকে কেন্দ্র করে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে মানুষকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাও ঘটে। এ সময় সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে ভয় পাচ্ছিলেন অভিভাবকেরা। ছেলেধরা সন্দেহে ঢাকার মোহাম্মদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে দুজনকে পিটিয়ে হত্যা করে এলাকাবাসী। মোহাম্মদপুরে এক নারীকে একই সন্দেহে বেদম মারধর করা হয়। পুলিশ গিয়ে তাঁকে উদ্ধার করে।

এ ছাড়া লক্ষ্মীপুর জেলার দালাল বাজারে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে পুলিশে দেয় জনতা। নেত্রকোনায় এক শিশুকে গলা কেটে হত্যা করে ব্যাগে করে মাথা নিয়ে যাওয়ার সময় সন্দেহভাজন যুবককে পিটিয়ে হত্যা করে স্থানীয়রা। আর এই খবর গণমাধ্যমে আসার পর নতুন করে শুরু হয় অপপ্রচার।

২০১৯ সালের ২০ জুলাই রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় এক নারীকে ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। ওই দিন সকালে রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় মেয়েকে ভর্তি করানোর তথ্য জানতে স্থানীয় একটি স্কুলে যান তাসলিমা বেগম রেনু (৪০)। এ সময় তাঁকে ছেলেধরা সন্দেহে প্রধান শিক্ষকের রুম থেকে টেনে বের করে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়।

একই সময়ে কেরানীগঞ্জের হজরতপুর ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামে ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে অজ্ঞাতপরিচয় দুই যুবককে গণপিটুনি দেওয়া হয়। এ ঘটনায় একজনের মৃত্যু হয়। পুলিশের ভাষ্য, রসুলপুর গ্রামে শরীফ মিয়ার বাড়ির সামনে দুই যুবক ঘোরাফেরা করতে থাকেন। এলাকাবাসীর সন্দেহ হলে তাঁদের ঘোরাফেরার কারণ জিজ্ঞাসা করা হয়। দুই যুবক ঠিকঠাক উত্তর দিতে না পারায় এলাকাবাসী ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁদের পিটুনি দেয়। তাঁদের একজন মারা যান।

রাজশাহীতে নিজের ঘরে কাচের আঘাতে এক শিশুর গলায় আঘাত পাওয়ার পর এ নিয়ে শুরু হয় জল্পনা। শিশুটিকে হাসপাতালে ভর্তির পরপর গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, তার মাথা কেটে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে।

যেভাবে গুজব ছড়ায়
২০১৫ সালের ১ মার্চ নদীতে পশুর রক্ত ঢেলে পদ্মা সেতুর ভিত্তি স্থাপনকাজের উদ্বোধন করে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় মূল সেতুর পরীক্ষামূলক ভিত্তি স্থাপনের সময় নদীতে গরু ও খাসির রক্ত ঢালতে দেখা যায় চাইনিজ ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের। ভাসিয়ে দেওয়া হয় কয়েকটি মুরগিও। তাদের বিশ্বাস, বড় কাজের শুরুতে পশু উৎসর্গের মাধ্যমে স্রষ্টার সন্তুষ্টি লাভ করা যায়, এড়ানো যায় বড় দুর্ঘটনা।

তখন গণমাধ্যমেও এ নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সময়ের রক্তের ছবিই ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়েছিল অসাধু ফেসবুক ব্যবহারকারীরা। মূল তথ্য আড়াল করে পুরোনো সেই ছবিকে মানুষের রক্তের ছবি বলে প্রচার করতে থাকে তারা।


গুজব কেন ছড়িয়েছে

পদ্মা সেতু নিয়ে বিভিন্ন সময়ে যেসব গুজব ছড়িয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশই বিশ্বাসযোগ্য দলিল ছাড়াই ছড়িয়েছে। এর পেছনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় একটি মহল উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাজ করেছে। তবে এসব গুজব ছড়ানোর জন্য আবহমান কাল ধরে চলে আসা জনশ্রুতি এবং স্থানীয় সংস্কৃতিতে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন গল্পের ওপর বিশ্বাস করার প্রবণতাও দায়ী।

এই যেমন কথিত আছে, ১৫৮০ সালের দিকে মৌলভীবাজারে কমলার দিঘি তৈরি করার সময় দিঘিতে যখন পানি উঠছিল না, তখন রাজা স্বপ্নে দেখেন যে, তাঁর স্ত্রী দিঘিতে আত্মবিসর্জন দিলে পানি উঠবে। পরে রাজার স্ত্রী আত্মাহুতি দেওয়ার ফলেই ওই দিঘিতে পানি ওঠে। দিনাজপুরের রামসাগর নিয়েও একই ধরনের কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে।

এসব ঘটনার কোনো প্রামাণিক দলিল বা সুনিশ্চিত ঐতিহাসিক প্রমাণ না থাকলেও শত শত বছর ধরে মানুষের মুখে মুখে চলে আসার কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে এ ধরনের গল্পের একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়।’

প্রধানমন্ত্রীর সতর্কবার্তা
পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেও ভবিষ্যতেও এ রকম গুজব ছড়াতে পারে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পদ্মা সেতু নিয়ে যেকোনো গুজব ঠেকাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কঠোর নজরদারি করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। গত ১৪ জুন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নিরাপত্তাসংক্রান্ত জাতীয় কমিটির বৈঠকে এ নির্দেশনা দেন তিনি।