যাত্রীবেশে দেড় বছরে মহাসড়কে ১৫ বাসে ডাকাতি
অনলাইন ডেস্ক: সম্প্রতি ঢাকার আশুলিয়ায় হানিফ পরিবহন ও গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে স্টার লাইন পরিবহনের বাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ওই দুইটিসহ বিভিন্ন সময়ে দূরপাল্লার বাসে ডাকাতির সঙ্গে জড়িত আন্তঃজেলা ডাকাতচক্রের ১০ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। গ্রেপ্তারের সময় তারা ডাকাতি প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বলে জানিয়েছে র্যাব। এ সময় তাদের কাছ থেকে দেশি ও বিদেশি অস্ত্র জব্দ করা হয়।
র্যাব বলছে, ডাকাত চক্রটি গত দেড় বছরে যাত্রীবেশে মহাসড়কে ১৫টির বেশি ডাকাতি করেছে। চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। কারাগারে গিয়ে তারা জামিন নিয়ে এসে আবারও ডাকাতির কাজে লিপ্ত হন। এছাড়া ঢাকা-দিনাজপুরগামী একটি বাসে ডাকাতির সময় ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটান তারা।
রোববার বেলা সাড়ে ১১টায় কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন র্যাবের লিগ্যাল আ্যন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
এর আগে শনিবার (১১ জুন) রাতে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে ঢাকার আশুলিয়া এলাকা থেকে র্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-৮ এর একটি অভিযানিক দল তাদের গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তাররা হলেন- ওই ডাকাতচক্রের সর্দার হিরা শেখ ওরফে কালাম শেখ ওরফে সোলেমান শেখ (৪০), হাসান মোল্লা ওরফে ইশারত মোল্লা (৩৯), আরিফ প্রামাণিক ওরফে আরিফ হোসেন (৩৩), নুর ইসলাম (৫৩), রাজু শেখ ওরফে রাজ্জাক (৫৪), রেজাউল সরকার (৪৯), মো. রতন (৩৬), শরিফুল ইসলাম (৩৯), মো. হানিফ (৪২) ও নজরুল ইসলাম (৩৫)।
এ সময় তাদের কাছ থেকে ডাকাতিতে ব্যবহৃত একটি বিদেশি পিস্তল, তিন রাউন্ড গুলি, আটটি দেশি অস্ত্র, শ্যামলী এনআর ট্রাভেলসের চারটি টিকিট ও তিনটি ব্যাগ উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তাররা ঢাকা-রাজশাহীগামী একটি বাসে ডাকাতির পরিকল্পনা করছিলেন।
র্যাবের লিগ্যাল আ্যন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক বলেন, গত ২৯ মে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে ঢাকা হতে গোপালগঞ্জগামী স্টারলাইন পরিবহনে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে গত ৮ জুন ডাকাত মহব্বত ওরফে রয়েলকে লুন্ঠিত মালামালসহ রাজশাহী থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। রয়েলকে জিজ্ঞাসাবাদে র্যাব গোয়েন্দারা বিভিন্ন ডাকাতির ঘটনা সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য পায়। র্যাব জানতে পারে ডাকাত হীরার নেতৃত্বে এই সংঘবদ্ধ ডাকাত দলটি গত এক মাসে ৩টি দূরপাল্লার বাসে ডাকাতি করে। এই ডাকাতচক্রটি গত ১১ মে চট্টগ্রাম থেকে যশোর-বেনাপোলগামী হানিফ পরিবহন, ২৫ মে ঢাকা-রাজশাহীগামী ন্যাশনাল ট্রাভেলস পরিবহন এবং ২৯ মে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে ঢাকা থেকে কোটালীপাড়াগামী স্টারলাইন পরিবহনে ডাকাতি করে বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়। এর ফলে র্যাব ডাকাত চক্রটিকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে গোয়েন্দা নজরদারি আরও বৃদ্ধি করে।
তিনি বলেন, গ্রেপ্তাররা একটি সংঘবদ্ধ ডাকাতচক্র। এই দলের সদস্য সংখ্যা ১০-১৫ জন। গ্রেপ্তার ডাকাত সর্দার হীরা ও তার অন্যতম সহযোগী হাসান মোল্লা বিভিন্ন ডাকাতির পরিকল্পনা করে থাকেন। ডাকাত দলটি দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন জেলামুখী যাত্রীবাহী বাসে উঠে ডাকাতি করে আসছিল। গত দেড় বছরে তারা প্রায় ১০-১৫টি বাসে ডাকাতি করেছে। এর আগে চক্রটি ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে শ্যামলী পরিবহন ও মামুন ট্রাভেলস, ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে ন্যাশনাল ট্রাভেলস ও একতা ট্রাভেলসে ডাকাতি করে বলে জানায়।
এছাড়া, চট্টগ্রাম-সিলেট মহাসড়কে সৌদিয়া বাসে ডাকাতির সময় তারা বাসচালকের হাতে ও হেলপারের পেটে ছুরিকাঘাত করে। এছাড়াও এই চক্রটি ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে ফাল্গুনী ট্রাভেলস, সুন্দরবন এক্সপ্রেস ও কণক পরিবহন, ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে সুরভী পরিবহন, হানিফ পরিবহন, সিলেট-রাজশাহী মহাসড়কে শ্যামলী পরিবহন ও রইস পরিবহন, ঢাকা-পাবনা মহাসড়কে পাবনা এক্সপ্রেস ও সরকার ট্রাভেলস, রাজশাহী-বরিশাল মহাসড়কে সেবা গ্রীনলাইন পরিবহন ও তুহিন পরিবহনে ডাকাতি করে।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, তিনবছর আগে ঢাকা-দিনাজপুরগামী একটি বাসে ডাকাতির সময় ধর্ষণের মত ঘটনা ঘটায় বলে জানায়। সর্বশেষ তারা ঢাকা থেকে গোপালগঞ্জগামী স্টারলাইন পরিবহনে ডাকাতি করেন। ডাকাতির জন্য তারা ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন দূরপাল্লার আন্তঃজেলা বাসগুলোকে টার্গেট করেন। এক্ষেত্রে চক্রটির কয়েকজন আগে থেকেই কাউন্টার থেকে টিকিট কেনার মাধ্যমে বাসে ওঠেন। অন্য সদস্যরা পরবর্তী বিভিন্ন কাউন্টার থেকে টার্গেটকৃত বাসে ওঠেন। এছাড়াও, যেসব দূরপাল্লার বাস কাউন্টার ব্যতীত যাত্রী ওঠায় তারা এসব বাসকে প্রাধান্য দিয়ে ডাকাতি করেন।
সাধারণত তারা মহাসড়কের নির্জন এলাকায় বাস ডাকাতির জন্য বেছে নিতেন। ডাকাতি করার পর তারা পুনরায় আশুলিয়ায় ফিরে আসেন। এছাড়াও, বিভিন্ন সময় তারা বাড়িঘরে ডাকাতি করতেন বলে জানা যায়। ইতোপূর্বে গ্রেপ্তারকৃত সবাই ডাকাতিসহ অন্যান্য মামলায় ২-৬ বছর মেয়াদে কারাভোগ করেছেন।
র্যাবের মুখপাত্র বলেন, গ্রেপ্তার হিরা শেখ জানান, তিনি এই ডাকাতচক্রের অন্যতম মূলহোতা। আগে তিনি গার্মেন্টস পণ্য বিক্রির সঙ্গে জড়িত ছিল। পরে ডাকাতির পেশায় জড়িয়ে পড়েন এবং দীর্ঘ ১০-১২ বছর ধরে ডাকাতি করেন। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি বাস ডাকাতি তার নেতৃত্বে হয়েছে। প্রত্যেকটি পরিবহনে ডাকাতিতে তিনি নিজে সশরীরে অংশ নেন। ডাকাতির সময় তিনি পরিবহনে উঠে প্রথমে বাস স্টাফদের এবং যাত্রীদের মারধর করে ভীতির সঞ্চার করেন। পরে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে এবং যাত্রীদের কাছ থেকে নগদ অর্থ, মোবাইল এবং স্বর্ণালঙ্কার লুট করতেন। তার নামে দেশের বিভিন্ন থানায় ডাকাতিসহ অস্ত্র আইনে মোট ৭টি মামলা রয়েছে।
গ্রেপ্তার হাসান মোল্লাকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তিনি এই ডাকাত সর্দারের অন্যতম সহযোগী এবং দীর্ঘ ১০-১২ বছর ধরে ডাকাতি করে আসছেন। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি বাস ডাকাতির পরিকল্পনাকারী ও বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ডাকাতির সময় তিনি পরিবহনে উঠে প্রথমে বাস স্টাফদের এবং যাত্রীদের মারধর করে ভীতির সঞ্চার করতেন। পরে তাদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে রাখতেন। তার নামে দেশের বিভিন্ন থানায় ডাকাতিসহ অস্ত্র আইনে মোট ১০টি মামলা রয়েছে।
গ্রেপ্তার নুর ইসলাম, হানিফ, আরিফ, শরীফ ও রতন এই চক্রের অন্যতম সদস্য। তারা পেশায় অটোরিকশা ও পিকআপ ভ্যান চালকসহ অন্যান্য পেশার আড়ালে ডাকাতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। গত দশ বছর ধরে তারা বিভিন্ন স্থানে ডাকাতি করে আসছেন। ডাকাতির সময় তারা বাসের ড্রাইভারকে জিম্মি করে নিজেরাই বাসের ড্রাইভিং সিটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতেন। গ্রেপ্তার আরিফ ও শরীফ ড্রাইভার এবং সুপারভাইজারকে অস্ত্রের মুখে গাড়ির পেছনের সিটে হাত-পা বেঁধে রেখে তাদের পাহারা দিতেন। গ্রেপ্তার শরীফ ৮ থেকে ১০ বছর ধরে বিভিন্ন স্থানে ডাকাতি করে আসছেন। তার নামে বিভিন্ন থানায় ডাকাতিসহ অন্যান্য অপরাধে ৮টি মামলা রয়েছে।
গ্রেপ্তার আরিফের নমে দস্যুতার মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তার নুর, হানিফ ও রতন ডাকাতির সময় অস্ত্রের মুখে যাত্রীদের মালামাল লুট করতেন। গ্রেপ্তার নুরের নামে ডাকাতি, অস্ত্র, বিস্ফোরক আইনে বিভিন্ন থানায় ৪টি মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তার হানিফের নামে ডাকাতি ও মাদক আইনে ২টি মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তার রতনের নামে ডাকাতি ও মাদক আইনে বিভিন্ন থানায় ৫টি মামলা রয়েছে। এর আগে তারা এসব মামলায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন।
এছাড়াও গ্রেপ্তার রাজু ও রেজাউল এই চক্রের অন্যতম সদস্য। রাজু দীর্ঘ ১৬-১৭ বছর ধরে বিভিন্ন স্থানে ডাকাতি করে আসছেন। তার নামে অস্ত্র ও ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে ৩টি মামলা রয়েছে। তিনি ডাকাতির সময় অস্ত্রের মুখে যাত্রীদের মালামাল লুট করতেন। গ্রেপ্তার রেজাউল ডাকাতির সময় গাড়ির গেটে পাহারা দিতেন। তার নামে মাদক, ডাকাতি, ছিনতাই ও অস্ত্র আইনে মোট ৬টি মামলা রয়েছে। পরিবহনে ডাকাতির সময় তারা যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা, মোবাইল ফোন এবং স্বর্ণালঙ্কার লুটের কাজ করতেন। গ্রেপ্তার নজরুল ডাকাত দলটির লুটকৃত স্বর্ণ কিনে সেগুলো গলিয়ে বিভিন্ন জুয়েলারি দোকানে বিক্রি করতেন।
দীর্ঘদিন ধরে ডাকাতি করে চক্রটি কী পরিমাণ সম্পদ গড়েছে জানতে চাইলে র্যাবের লিগ্যাল আ্যন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মঈন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ডাকাতি করলেও চক্রের সব সদস্যর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। এসব মামলায় হাজিরাসহ বিভিন্নভাবে টাকা খরচ হয়ে যেত। এ কারণে তারা সেভাবে সম্পদ গড়তে পারেননি।