ঢাকা | মে ২২, ২০২৪ - ১২:৪০ পূর্বাহ্ন

‘যেন মৃত্যুকূপ থেকে ফিরে আসলাম’

  • আপডেট: Tuesday, June 7, 2022 - 11:55 am

অনলাইন ডেস্ক: চালক রুবেল মিয়া কাভার্ডভ্যানে ঢাকা থেকে তৈরি পোশাক নিয়ে গিয়েছিলেন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে। শনিবার রাতে যখন বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন লাগে, তখন তিনি দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। ভেবেছিলেন, দাঁড়িয়ে আছেন নিরাপদ দূরত্বেই। ঘণ্টাখানেক পর কনটেইনার বিস্ম্ফোরণ হয় এবং তাঁর শরীরে তরলজাতীয় কিছু এসে পড়ে।

শরীরের প্রচণ্ড জ্বালা-পোড়া শুরু হওয়ায় পোশাক খুলে ফেলেন তিনি। ডিপো থেকে বাইরে বের হওয়ার চেষ্টা করেও প্রথম পর্যায়ে বের হতে পারেননি। আধাঘণ্টা পর একটি পকেট গেট দিয়ে দগ্ধ অবস্থায় বেরিয়ে হাসপাতালে যান। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়।

৩৮ বছরের রুবেল মিয়া রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডের ১৩ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন। গতকাল সোমবার দুপুরে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। বিস্ম্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী রুবেল মিয়া ওই ঘটনা বর্ণনা করেন। জানালেন, আগুন লাগার কিছুক্ষণ পরই ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আসে। কিন্তু আগুন বাড়তেই থাকে। যেখানে আগুনের সূত্রপাত সেখানে ১৫-১৬টি কনটেইনার ছিল। নিচ থেকে আগুন ধরে। তিনি দাঁড়িয়ে দেখছেন, আগুন ওপরের দিকে উঠছে। হঠাৎ কনটেইনার বিস্ম্ফোরণ ঘটে।

রুবেল বলেন, ‘যেন মৃত্যুকূপ থেকে ফিরে আসলাম। আগুনের শুরুতেই যদি বের হয়ে যেতে পারতাম তাহলে আজ হাসপাতালে শুয়ে থাকতে হতো না। খুব কষ্ট হচ্ছে। ঠোঁট ঝলসে যাওয়ায় খেতেও পারছি না ঠিকমতো।’

সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ম্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দগ্ধ ১৫ জন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন। আবাসিক সার্জন ডা. পার্থ শংকর পাল বলেন, দগ্ধদের মধ্যে চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে। বাকি ১১ জন চিকিৎসাধীন পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে। এ ছাড়া একজন ভর্তি আছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন বিএম কনটেইনার ডিপোর প্রশাসনিক কর্মকর্তা খালেদুর রহমানের শরীরের ১২ শতাংশ, নিরাপত্তা কর্মকর্তা এ কে এম মাকফারুলের ১২, পুলিশের এসআই কামরুল হাসানের ৪, রপ্তানি তত্ত্বাবধায়ক শেখ মইনুল হকের ১৮, শ্রমিক আমিনের ৫, গাড়িচালক ফারুকের ৫, রিসিভার ফরমানুলের ৩০, ইঞ্জিনিয়ার মাসুম মিয়ার ৪, ফায়ার সার্ভিসের কর্মী রবিনের ৬০ ও গাউসুল আজমের ৭০, গাড়িচালক মহিবুল্লাহর ১০, শ্রমিক ফারুক হোসেনের ১২ এবং গাড়িচালক রুবেল মিয়ার শরীরের ১৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। গতকাল নজরুল মণ্ডল ও সজীব নামের দু’জনকে সীতাকুণ্ড থেকে এনে ভর্তি করা হয়।

হাসপাতালেই কাটছে স্বজনদের দিন-রাত। পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডের সামনের ফাঁকা জায়গায় দুপুরে বসে ছিলেন দগ্ধ গাড়িচালক নজরুল মণ্ডলের স্ত্রী রূপা বেগম এবং তাঁদের আড়াই বছরের মেয়ে হাবিবাসহ স্বজনরা। রূপা জানান, গতকাল ভোরে তাঁর স্বামীকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আনা হয়। তাঁর শরীরের ২০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। তিনি ফরিদপুরের বাড়ি থেকে এসেছেন হাসপাতালে। সকাল ১১টার দিকে ওয়ার্ডে স্বামীকে দেখার সুযোগ হয়েছিল তাঁর।

রূপা বলেন, ‘মেয়ের আব্বু ঠিকমতো কথা বলতে পারছে না। আমাকে আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করে, ছোট মেয়েকে নিয়ে এসেছি কিনা। তাকে দেখতে মন চাচ্ছে তার। মেয়েকে ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে বলল।’

রূপাদের পাশেই বসে ছিলেন দগ্ধ ২২ বছরের তরুণ আমিনের মা পারুল বেগম, ভাই ও চাচা। পারুলের চোখে তখন পানি। চোখ মুছতে মুছতে সমকালকে জানালেন, তাঁদের গ্রামের বাড়ি মাগুরায়। তাঁর ছেলে এবার এইচএসসি পাস করেছে। গ্রামের কয়েকজন সীতাকুণ্ডের ডিপোতে কাজ করেন। তাঁদের সঙ্গে ১০-১২ দিন আগে যায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করার জন্য। ৭-৮ দিন কাজে যোগ দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘ওয়ার্ডে গিয়ে ভালো আছে কিনা জিজ্ঞাসা করলাম ছেলেকে। বলল, না মা। ভালো নেই।’

ওয়ার্ডে কথা হয় আমিনের সঙ্গে। তিনি জানান, প্রাচীরের পাশে একটি দোকানে বসে ছিলেন। তখন আগুন জ্বলছিল ডিপোতে। হঠাৎ বিকট শব্দ হওয়ার পর তাঁর শরীরে কিছু একটা পড়ার অনুভব করেন। এরপরই জ্বালা-পোড়া শুরু হয়।

গতকাল দুপুর সোয়া ২টায় দগ্ধদের খোঁজখবর নিতে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে যান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, বিস্ম্ফোরণ ও আগুনের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী সবসময় খোঁজখবর নিচ্ছেন। দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন আমাদের। মন্ত্রী বলেন, ঘটনায় যারা দায়ী, তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সোনালী/জেআর