অস্বস্তির কথা জানালেন বিদায়ী সিইসি
অনলাইন ডেস্ক: সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা জানিয়েছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কতগুলো বিষয় নিয়ে অস্বস্তিতে ছিলাম। কোথাও কোথাও শতভাগ ভোট পড়েছে। এগুলো আমি সাংবাদিকদের বার বার বলেছি। আমি আসার আগেই এসব প্রশ্নের উত্তর মিডিয়ার সামনে পরিষ্কার করেছি। এটা একটা অস্বস্তিকর বিষয়, গ্রহণযোগ্য বিষয় নয় যে শতভাগ ভোট হবে।
তিনি বলেন, তবে আমি সঙ্গে সঙ্গে বলেছি যে, এখান থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় হলো আদালত। ইসির সীমাবদ্ধতা হলো রিটার্নিং অফিসার যদি আনুষ্ঠানিকভাবে ফল ঘোষণা করেন, তাহলে ইসির হাতে আর কিছু থাকে না। সেটা চলে যায় আদালতে। তফসিল ঘোষণার পর থেকে ফলাফল প্রদান পর্যন্ত ইসির নির্বাচন সংক্রান্ত কাজ যোগ করেন সাবেক সিইসি।
শনিবার দুপুরে তেজগাঁওয়ের এফডিসিতে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি আয়োজিত ‘বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন সম্ভব’ শীর্ষক ছায়া সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা জানান।
মেয়াদ শেষের পর প্রথমবারের মতো গণমাধ্যমের মুখোমুখি হওয়া কে এম নূরুল হুদার কাছে ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি নিজের অস্বস্তির কথা জানান।
তিনি আরও বলেন, আমরা অনেক বড় বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সংসদ সদস্য যারা আচরণবিধি মানেননি, তাদের বিরুদ্ধে মামলা আছে। একাধিক মামলা আদালতে পেন্ডিং আছে। কুমিল্লার একটা পুরো নির্বাচন আমরা স্থগিত করেছি। বহু নির্বাচনের কেন্দ্র বন্ধ করেছি। ইসির কাছে অভিযোগ এলেই সঙ্গে সঙ্গে সেটা বন্ধ করা যায় না। সেটার একটা তাৎক্ষণিক তদন্ত করতে হয়। সত্য-মিথ্যা যাচাই করে নির্বাচন কমিশন সন্তুষ্ট হয়। তারপর ইসি সিদ্ধান্ত নেয়। আমি তাদের আহ্বান জানিয়েছিলাম, আপনারা আসেন আদালতের শরণাপন্ন হন। কারণ ইসির হাতে কিছু আর নেই। এ ব্যাপারে একটা অস্বস্তি আছে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ছয় মাস পর প্রকাশিত কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফলে অস্বাভাবিক ভোট পড়ার চিত্র উঠে আসে। শতাধিক কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ার ঘটনায় তৎকালীন সিইসি কে এম নূরুল হুদা বলেছিলেন, ‘শতভাগ ভোট পড়াটা অস্বাভাবিক’।
কমিশনারদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতপার্থক্য ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, সবার সম্মতিক্রমেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
নূরুল হুদা বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন পরিচালনা করা ইসির জন্য কিছুটা চ্যালেঞ্জ। তবে সেটি কমিশন চাইলে অতিক্রম করা সম্ভব। পাঁচ বছর দায়িত্ব পালনকালে কোনো চাপ সৃষ্টি হয়নি।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি না এলে সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, না, পাবে না। আমি মনে করি এই নির্বাচনে বিএনপিকে নির্বাচনী মাঠে আনতে হবে এবং সেটার দায়িত্ব সরকারি দলকে নিতে হবে। বিএনপিকেও আমার অনুরোধ থাকবে, নির্বাচন বর্জন করে, বয়কট করে সমস্যার সমাধান হবে না। আপনারা আলোচনা করে ঠিক করবেন কীভাবে নির্বাচনে যাবেন। বিএনপিকে নির্বাচনে অংশগ্রহনের জন্য আহ্বান জানান তিনি।
সাবেক এই সিইসি বলেন, বন্দুকের নল এবং লাঠিচার্জ করে গণতন্ত্র কায়েম করা যায় না, উচিতও না। আমাদের দেশে যেটা হয়, এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জনগণ ভোট দিতে যাবেন স্বেচ্ছায়।
তিনি আরও বলেন, অন্যকোনো দেশে আমাদের মতো নির্বাচনের সময় যুদ্ধ করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় না। জনগণ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে যাবে, সেখানে কেনো পুলিশ থাকবে, আর্মি থাকবে, বিজিবি থাকবে, র্যাব থাকবে, ম্যাজিস্ট্রেট থাকবে? ১১-১২টা সংস্থা নির্বাচনকালীন দায়িত্বপালন করে। কেন? এখানে থাকবে শুধু নির্বাচন ব্যবস্থাপনার লোক এবং ভোটার। এই অবস্থার অবসান তাৎক্ষণিকভাবে হবে না। এর জন্য সময় লাগবে, ধৈর্য লাগবে এবং কালচার লাগবে।
গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিতে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ ১০ দফা সুপারিশ তুলে ধরেন। সেগুলো হলো-
১. আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক করার লক্ষ্যে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ তাদের শরিকদের মধ্যে আালোচনার মাধ্যমে নির্বাচনের রূপরেখা ও রোডম্যাপ তৈরি করা।
২. নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন নির্মোহ পেশাজীবী ও সুশীল সমাজের ব্যক্তিদের সঙ্গে সংলাপে যেসব প্রস্তাব এসেছে সেগুলো প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করা।
৩. বিগত নির্বাচন কমিশনগুলোর চ্যালেঞ্জের বিভিন্ন দিক চিহ্নত করে বর্তমান কমিশনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৪. সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ না থাকলে বর্তমান কমিশনকে পদত্যাগ করার মানসিকতা থাকতে হবে।
৫. রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে ইভিএমের ব্যবহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া।
৬. নির্বাচনের পূর্বে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিরোধ দূর করতে ইসিকে সরকারের সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা।
৭. অকারণে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়ার মতো পরিবেশ যেন তৈরি না হয় সেদিকে ইসিকে দৃষ্টি দেওয়া।
৮. যেসব আইনের দ্বারা নির্বাচনকালীন সংবাদ পরিবেশনে গণমাধ্যম বাধার সম্মুখীন হতে পারে সে আইন বাতিল করা।
৯. নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধীমতের রাজনৈতিক দলগুলোতে উন্নয়ন ব্যাহত হয় এমন কর্মসূচি পরিহার করা।
১০. জেলা প্রশাসকদের বদলে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব দেওয়া।
প্রতিযোগিতায় কুমিল্লা ইউনিভার্সিটিকে পরাজিত করে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের বিতার্কিকরা বিজয়ী হন। ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি’র আয়োজনে ছায়া সংসদের বিষয় ছিল- ‘বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন সম্ভব।’
ছায়া সংসদে মক স্পিকার হিসেবে সভাপতিত্ব করেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ। প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন অধ্যাপক আবু মোহাম্মদ রইস, ড. এস এম মোর্শেদ, সাংবাদিক তানিয়া রহমান ও একরামুল হক সায়েম। প্রতিযোগিতা শেষে অংশগ্রহণকারী দলের মাঝে ট্রফি ও সনদপত্র বিতরণ করা হয়।