ঢাকা | ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪ - ১:১৪ অপরাহ্ন

জিআই স্বত্ব স্বীকৃতির রায়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জে মিশ্র প্রতিক্রিয়া!

  • আপডেট: Friday, May 27, 2022 - 9:03 pm

চাঁপাইনবাবগঞ্জ ব্যুরো: ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে ফজলি আমকে ‘রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম’ কে জিআই স্বীকৃতির রায়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।

জানা গেছে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর যে সকল শর্তের প্রেক্ষিতে জিআই পণ্যের স্বীকৃতি প্রদান করে সেগুলো হলো (ঐতিহাসিক, ভৌগলিক, উৎপাদন ও বিপনন)। অথচ রাজশাহীর ক্ষেত্রে সেসব শর্ত পূরণ না করেই ‘রাজশাহীর ফজলি আম’(জিআই) স্বীকৃতি দেন। অথচ ফজলী আমের ক্ষেত্রে এসব শর্ত পূরণ করেছে বলেই আপত্তি শুনানীতে ফজলি আমকে ‘রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম’ হিসেবে জিআই স্বীকৃতি এককভাবে না দিয়ে শেষ মেশ যৌথভাবে দেয়া হলো। তাহলে কেন এককভাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জকে ‘ফজলি আমের’ জিআই স্বীকৃতি দেয়া হলনা?

এই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় একাধিক আমচাষী, বাগান মালিক, ব্যবসায়ী, গবেষক ও আম বিশেষজ্ঞ জানান, আমচাষি, বাগানমালিক, ব্যবসায়ী, চেম্বার, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন, স্মারকলিপি প্রদানসহ দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পর চাঁপাইনবাবগঞ্জ ফজলী আমের জিআই স্বীকৃতির অংশীদারিত্ব পেল। তবে, ঐতিহাসিক, ভৌগলিক, উৎপাদন, বিপননের দিক থেকে ফজলী আম চাঁপাইনবাবগঞ্জের এটাও প্রমাণিত হয়েছে। তিনি আরো জানান, পুণাঙ্গ রায়ের কপি পেলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ বাসীকে নিয়ে আলোচনার পর পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

প্রবীণ সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক সামশুল ইসলাম টুকু জানান, জাতীয় এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আম বলতে চাঁপাইনবাবগঞ্জকেই বুঝায় এবং সেটা প্রায় ১০০ বছরেরও অধিক সময় ধরে। দেশ বিভাগের প্রায় দেড়শত বছর আগে থেকেই মালদহ তথা গৌড়ের ফজলী আমের সুখ্যাতি রয়েছে। গৌড়ের অংশ হিসেবে সেই সুখ্যাতির পরিপূর্ণ অধিকারী চাঁপাইনবাবগঞ্জ। ১৮০০ সালের দিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত সংলগ্ন গৌড়ে ফজলবিবি নামে এক বৃদ্ধা বাস করতেন। সে সময় মালদহ জেলা কালেক্টর রাজভেনশ সরকারী কাজে গৌড়ে আসেন ও শিবির স্থাপন করেন। কালেক্টরের আগমন বার্তা শুনে এক বৃদ্ধা কালেক্টরের জন্য উপঢৌকন হিসেবে তার বাড়ীর আঙ্গিনার আমগাছের আম উপহার দেন। কালেক্টর আম খেয়ে তৃপ্ত হয়ে বৃদ্ধাকে সেই আমের নাম জানতে চান। বৃদ্ধা কথা বুঝতে না পেরে তার নিজের নাম বলেন। সেই থেকে আমটির নামকরণ হয় ‘ফজলী’।

কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে উৎপাদিত মোট আমের এক চতুর্থাংশ চাঁপাইনবাগঞ্জ জেলাতেই উৎপাদিত হয়। এ জেলায় ৩৮ হাজার হেক্টর জমিতে প্রায় ৪ লাখ টন আম উৎপাদিত হয়, যার ২৩% বা প্রায় ৮৫ হাজার মেট্রিক টন ফজলী আম উৎপাদিত হয়। যেখানে রাজশাহী জেলায় ফজলী আম উৎপাদন হয় মাত্র ২৮ হাজার টন। দেশভাগের পর থেকে সিংহভাগ আমের বিপনন হয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকেই। আমের জন্য লাগসই ভূপ্রকৃতি, আবহাওয়া ও তাপমাত্রা প্রয়োজন, তা চাঁপাইনবাবগঞ্জ শতভাগ নিশ্চিত করে বলেই আম গবেষনা কেন্দ্রের গবেষকরা জানান।

ইতিহাসবীদ গবেষক ও লেখক মোঃ জাহাঙ্গীর সেলিম জানান, রাজশাহীকে ফজলি আমের জিআই স্বীকৃতি, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ছাড়া আর কিছুই নয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় আমচাষের ইতিহাস দুই থেকে তিন হাজার বছরের। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষের মালদহ তথা দক্ষিণ মালদহ ছিল আমচাষের জন্য প্রসিদ্ধ। আর দক্ষিন মালদহের পুরোটা জুড়েই ছিল বতর্মান চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা। জেলার প্রধান অর্থকরী ফসল হিসেবে আমকে ঘিরেই আর্বতিত হয় এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা। এর মধ্যে উৎপাাদিত ২৩/২৪ শতাংশের দখলেই সুস্বাদু ও জনপ্রিয় নাবী জাত ফজলি আম। তিনি আরো জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জে কিন্তু আম সংস্কৃতি চালু আছে। আর দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানিও হচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম।

আদিনা ফজলুল হক সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষ ও লোকসংস্কৃতি গবেষক প্রফেসর ড. মাযহারুল ইসলাম তরু জানান, অবিভক্ত ভারতের এই চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলটি কিন্ত আমের জন্য বিখ্যাত ছিল। এখনো ধারাবাহিকতা রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অন্যতম প্রধান হচ্ছে ফজলি আম। ফজলি আম এঅঞ্চলে যত চাষ হয়, অন্যান্য জায়গাতে ততখানি চাষ হয়না। আলকাপগান ও গম্ভীরা গান গবেষনাকালে দেখা গেছে, প্রাচীন সংগীতে এখনাকার ঐতিহ্য আমের মধ্যে ফজলি আমের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং ডিস্টিক গ্রেজেট (১৯২৮-১৯৩৫) খুঁজে দেখা গেছে, সেখানে ফজলি আম চাঁপাইনবাবগঞ্জের অন্যতম একটি অর্থকরী ফসল হিসেবে দেখানো হয়েছে। তাই ফজলি আম চাঁপাইনবাবগঞ্জের একটি সম্পদ বলে স্বীকৃত। সেক্ষেত্রে কেন এককভাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জকে ‘ফজলি আমের’ জিআই স্বীকৃতি দেয়া হলনা?

শিবগঞ্জ ম্যাংগো প্রডিউসার কো-অপারেটিভ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল খান শামীম বলেন, বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশী ফজলি আম বেশী উৎপাদন হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জে। ২০০-২৫০ বছরের পুরানো ফলদানের উপযোগী ফজলি আমের বাগান অনেক রয়েছে। ইতিহাস, ভৌগলিক, উৎপাদনের বিষয় স্পস্ট হবার পরও এককভাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জকে ‘ফজলি আমের’ জিআই না দেয়ায় আমরা ব্যাথিত।

প্রধানমন্ত্রীর কৃষিপদকপ্রাপ্ত মোঃ রফিকুল ইসলাম জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভূপ্রকৃতি, আবহাওয়া ও তাপমাত্রা আমের জন্য বরাবরই ভাল। এ কারণে বড় বড় আমবাগানে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আমগাছে ফজলি আম রাখা যায়। অথচ রাজশাহীর ফজলি আম দীর্ঘ সময় রাখা যায় না। এখানকার বড় গাছে নূন্যতম ৭০-৮০ মন আম উৎপাদন হয়। যা অন্য কোন জেলায় হয়না। আর এসব ফজলি আমের স্বাদ অন্য জেলার আমের সাথে মিলবে না বলেই ভোক্তারা চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি বেছে নেয়। তিনি আরো জানান, এই রায়ে কিছুটা খুশি হলেও পুরোপুরি খুশি নয়।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষনা কেন্দ্রের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোখলেসুর রহমান জানান, বাঘা ফজলি নামে কোন জাত নেই, ফজলি আমের জাত একটি। তবে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আমের স্বাদ ও উৎপাদন দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশী। গত বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জে ফজলি আম উৎপাদিত হয় ৮৬ হাজার ৬’শ ৮০ মেঃ টন এবং রাজশাহীতে উৎপাদিত হয় মাত্র ১৭ হাজার মেঃ টন। সব বিবেচনায় দিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জেরই ফজলি আমের জিআই পাওয়া উচিত।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ নজরুল ইসলাম জানান, ফজলি আমের জিআই স্বীকৃতি পাওয়ায় এই অঞ্চলের চাষীরা এখন আরো অনুপ্রাণিত হবে। আর আমের নায্যমূল্য নিশ্চিতের পাশাপাশি উৎপাদন বাড়াতে আগ্রহী করবে কৃষকদের। তাই আগামীতে এই আমের সম্প্রসারণ এবং জিআই সুবিধা বাড়াতে কাজ করবে কৃষি বিভাগও।

চেম্বার অব কর্মাসের পরিচালক মোঃ শহিদুল ইসলাম শহিদ জানান, ‘রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম’ হিসেবে জিআই স্বীকৃতির রায়ে ব্যবসায়ীরা খুশি হলেও এককভাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জকে দিলে আরো বেশী খুশি হতো। এখন ফজলি আমকে জিআই ট্যাগ লাগিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণসহ বহিঃবিশে^ বাজার দখল করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পথ সুগম করতে হবে। আর বাজার সম্প্রসারণে সংকারের পৃষ্ঠপোষকতা দরকারের দাবী জানান তিনি।

উল্লেখ্য, রাজশাহীর বাঘা উপজেলার ‘ফজলি’ আমকে জিআই স্বীকৃতি দেয়ার জন্য ২০১৭ সালে আবেদন করেছিল রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্র। সেই আবেদনের পর যাচাই-বাছাই শেষে ২০২১ সালের ৬ অক্টোবর বাঘার ফজলি আমকে জিআই পণ্যের স্বীকৃতি দিয়ে জার্নাল প্রকাশ করা হয়।

আর স্বীকৃতির বিরুদ্ধে এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আমকে জিআই পণ্য হিসেবে ঘোষণার দাবি জানিয়ে ২০২১ সালের ৫ ডিসেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরে আপত্তি জানিয়ে আপিল করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশন।

সেই আপিলের ওপরই গত মঙ্গলবার ঢাকায় শুনানি শেষে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, ডিজাইন অ্যান্ড ট্রেডমার্ক অধিদপ্তরের রেজিস্ট্রার জনেন্দ্র নাথ সরকার ‘রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আমকে’ জিআই স্বত্ব স্বীকৃতির রায় ঘোষনা করেন।