আগামী সপ্তাহে আসছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম
ডাবলু কুমার ঘোষ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে: বাগানে থোকায় থোকায় দুলছে গোপালভোগ, খিরসাপাতি, রানীপচ্ছন্দ, বৃন্দাবনি ল্যাংড়া, ফজলি, আশ্বিনা, বারি-৪, আম্রপালি, ব্যানানা, ডকমাই, চাকতাসহ হরেক জাতের আম। আমের রাজধানী খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাগানগুলোতে এমন দৃশ্য নজর কাড়বে সবার। আর দিন দশেকের মধ্যেই কিছু জাতের আম পরিপক্ক হয়ে বিক্রির জন্য বাজারে উঠতে শুরু করবে। তাই বাগানমালিক ও চাষিদের এখন বাড়তি নজর পরিচর্যায়। যদিও নানা প্রতিকূলতার কারণে চলতি মৌসুমে আমের উৎপাদন অনেক কম হওয়ার কথা জানান বাগানমালিক ও ব্যবসায়ীরা।
আর কৃষি বিভাগ বলছে, সামনে নতুন কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা না দিলে উৎপাদনে তেমন কোন প্রভাব পড়বেনা। আর কোন বিপর্যয় না ঘটলে জেলার চাষি, বাগানমালিক ও ব্যবসায়ীরা চলতি আম মৌসুম জুড়ে বিভিন্নজাতের আম বিক্রি করে ৩ হাজার ১’শ ৫০ কোটি টাকার ব্যবসা করতে পারবেন।
গুটি থেকে এখন আঠিঁসহ পরিপক্ক হয়ে উঠছে ফলের রাজা আম। চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। শুরু হয়েছে আম পাড়া ও বাজারজাতকরণের প্রস্তুতি। চলতি বছর ফলন কম হলেও এ নিয়ে উৎসাহ আর উদ্দীপনার যেন শেষ নেই। কারণ এ জেলার প্রধান অর্থকরী ফসলই হচ্ছে আম। ইতোমধ্যে বাগানে বাগানে বসছে আমপাড়া ও বাজারজাত করার ঘরও।
এদিকে, আমবাজারগুলোতে আড়ত তৈরির কাজও চলছে পুরোদমে। এখন কবে আসবে বাজারে পাকা আম সবাই রয়েছেন সেই অপেক্ষায়। তবে, সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য শীঘ্রই হবে অপেক্ষার অবসান। তবে, গত বছরের ন্যায় এবারও থাকছে না আম ক্যালেন্ডার। অর্থাৎ আম পাড়ার কোন সুনির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করবে না প্রশাসন। তবে অপরিপক্ক আম বাজারজাত করলে কঠোরভাবে তা দমন করা হবে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে বাজারে আসবে গোপালভোগ জাতের আম। মে মাসের ২৫ থেকে ৩০ তারিখের মধ্যেই গোপালভোগ আম পাঁকতে শুরু করে। একই সময়ে বাজারে আসবে মহানন্দা ও গুটি জাতের আম। জানা যায়, বারি-২ বা লক্ষনভোগ ও ক্ষিরসাপাত আম জুনের প্রথম সপ্তাহে পাঁকা শুরু হবে। এরপর জুনের মাঝামাঝি সময়ে ল্যাংড়া ও মাসের শেষের দিকে বাজারে আসবে ফজলী আম। এমনকি ফজলী আমের পরপরই এক সপ্তাহ পর বাজারে আসবে বারি-৪ ও আম্রপালী জাতের আম। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ ও মাঝামাঝি সময়ে আসবে আশ্বিনাসহ আরও কয়েকটি নাবী জাতের আম।
সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়নের নয়াগোলা এলাকার আমচাষি, গোলাম মোস্তফা সুমন জানান, বছরের প্রথম আম পাঁকে গোপালভোগ। এর সাথে আরও কিছু গুটি জাতের আম বাজারে আসে। চলতি মৌসুমে গোপালভোগ আম পাড়তে আরও ১২ থেকে ১৫ দিনের মতো সময় লাগবে। মাসের শেষের দিকে এ জাতের আম বাজারে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। গুটি জাতের আম এখনো পাকা দেখা যায়নি।’
কানাসটের আম আড়তদার এমদাদু হক জানান, গোপালভোগ আর গুটি জাতের আম একসঙ্গে বাজারে আসে। আমরা বাগান কিনে রেখেছি। সব ধরনের আমের ব্যবসা করার অভিজ্ঞতা আছে আমাদের। চলতি মাসের ২৫ থেকে ৩০ তারিখের মধ্যে গোপালভোগ বাজারে আসবে বলে আমরা আশাবাদী।’
শিবগঞ্জ ম্যাংগো প্রডিউসার কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিডেটের সাধারণ সম্পাদক ও আম রফতানিকারক ইসমাইল খান শামিম বলেন, এমনিতেই চাঁপাইনবাবগঞ্জে গোপালভোগ জাতের আমের গাছের সংখ্যা কম। তাও আবার এবার আমের অফ ইয়ার, মানে গাছে আম কম। অন্যদিকে, আবহাওয়াগত কারনেও এবার বাজারে আম আসতে দেরি হতে পারে। তিনি আরও জানান, এখন বাজারে পাওয়া অনেক আমই অপরিপক্ক। তবুও চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহীর নামে এসব আম বাজারজাত করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। এ নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনকে আরও বেশি নজরদারি ও বাজার তদারকি বাড়াতে হবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মুনজের আলম মানিক জানান,‘গত কয়েক বছর আমের দাম না পাওয়ায় ব্যাপক লোকসান গুনতে হয়েছে এ অঞ্চলের চাষিদের। তবে নানা প্রতিকূলতায় আমের উৎপাদন অনেক কম হলেও; এবার করোনার প্রভাব ও বাজারজাতকরণে বাধা নিষেধ না থাকায় আমের ভালো দাম পাবার আশা করছি আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানত্তত্ব গবেষনা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোখলেসুর রহমান জানান, এ মাসের শেষ দিক থেকে সবাই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন আমের স্বাদ নিতে পারবেন। তবে, ভালো আম পেতে আরও একটু অপেক্ষা করতে হবে। আবহাওয়ার তারতম্যের কারণে ফল একটু আগে ও পরে পাকতে পারে। গত কয়েকদিন ধরে ধারাবাহিকভাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জে বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টির কারনে চলতি মাসে আবহাওয়া কিছুটা শীতল থাকলে আম পাঁকতে এক সপ্তাহ দেরি হতে পারে। তবে আবহাওয়া স্বাভাবিক থাকলে সঠিক সময়েই আম পাঁকবে ও বাজারে আসবে।’
এ অবস্থায় আমের ভালো ফলন নিশ্চিতে ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমন থেকে রক্ষায় বাগানমালিক ও চাষিদের বালাই নাশক স্প্রেসহ নানা পরামর্শ দিচ্ছেন ফল গবেষকরা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, এবছর গাছ থেকে আম সংগ্রহের নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়নি। সময় বেঁধে দিলে অনেক ক্ষেত্রে অপরিপক্ব আমও পাড়া হয়। তবে, আম ক্যালেন্ডার না থাকলেও অপরিপক্ক আম বাজারজাতের বিষয়টি কঠোরভাবে নজরদারিতে রাখা হবে। এমনকি এনিয়ে কৃষকদেরকে সচেতনও করা হয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক এ কে এম গালিভ খান বলেন, গাছে আম পাকলেই, সেই আম বাজারে নামাতে পারবে কৃষকরা। আর যদি কেউ অপরিপক্ক আম বাজারে নামায়, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর একারণে চলতি আম মৌসুমে আমপাড়ার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়নি। তিনি আরো বলেন, নিরাপদ ও বিষমুক্ত আম উৎপাদনে মনিটরিং কমিটি ও ভ্রাম্যমান আদালত সবসময় সক্রিয় থাকবে, আমবাগানে অতিরিক্ত কীটনাশক যাতে প্রয়োগ না করে সেজন্য প্রতিটি বাগানমালিকদের লকবুক ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
আর আম বিপনন এবং বাজারজাতকরণে যেহেতু এখন করোনা পরিস্থিতি নেই সেক্ষেত্রে সারাদেশে পরিবহন ব্যবস্থা স্বাভাবিক রয়েছে, সাথে থাকবে কুরিয়ার এবং অনলাইনে আম পাঠানোর সবধরণের সুযোগ, তারপরও কমখরচে এবং দ্রুতসময়ে আম পৌছানোর জন্য এবারও ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন চালু থাকবে। আর ব্যবসায়ীদের সব ধরণের নিরাপত্তা নিশ্চিতের ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসক আরো বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন আমের ঐতিহ্য ও সুনাম বজায় রাখতে বিষমুক্ত ও নিরাপদ আম উৎপাদন ও বিপণনে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।
কৃষি অফিস সূত্রে প্রকাশ, গত ২০১৯ সালে ২ লাখ ৩৯ হাজার মেট্রিক টন আমের উৎপাদন হয় এবং ১ হাজার ৭’শ ৯১ কোটি টাকার আমের ব্যবসা হয়। গত ২০২০ সালে ২ লাখ ৪৫ হাজার মেট্রিক টন আমের উৎপাদন হয় এবং ২ হাজার ৫’শ ৭ কোটি টাকার আমের ব্যবসা হয়। আর গত ২০২১ সালে ৩ লাখ ৮২ হাজার মেট্রিক টন আমের উৎপাদন হয় এবং ৩ হাজার কোটি টাকার আমের ব্যবসা হয়।
আর এবছর চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩৮ হাজার হেক্টর জমিতে আমের চাষা হয়েছে। প্রায় ৫৫-৬০ লাখ গাছে চলতি মৌসুমে কৃষি বিভাগ জেলায় আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৩ লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন। এতে ৩ হাজার ১’শ ৫০ কোটি টাকার আম বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে।