সিরাজগঞ্জের তাঁত পল্লীতে ফিরেছে কর্ম চাঞ্চল্যতা
রফিকুল ইসলাম, সিরাজগঞ্জ থেকে: সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি, এনায়েতপুর, শাহজাদপুর, চৌহালী ও উল্লাপাড়ায় রয়েছে অসংখ্য তাঁত পল্লি। করোনার ধাক্কা কাটিয়ে হঠাৎ কর্ম চাঞ্চল্যতা ফিরে এসেছে এই পল্লিগুলোতে। ঈদকে সামনে রেখে এই চাঞ্চল্য আরও বেড়ে গেছে।
দিনরাত খট খট, ঝুম ঝুম আওয়াজই জানান দিচ্ছে আবারও জেগে উঠেছে সিরাজগঞ্জ জুড়ে শত শত তাঁত পল্লি। শব্দ আর সুতার বুননে তৈরি হচ্ছে জামদানি, সুতি কাতান, চোষা, বেনারসি, শেড শাড়ি, লুঙ্গিসহ নানা কাপড়।
কাপড় তৈরির বিশেষ এই তাঁত শিল্পটি করোনার কারণে স্তব্ধ হয়ে ছিল টানা প্রায় দুই বছর। মহামারি কাটিয়ে দিন যত স্বাভাবিক হচ্ছে বাজারে তাঁতের কাপড়ের চাহিদাও তত বাড়ছে। এর সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে রমজানের ঈদের আমেজও।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিরাজগঞ্জের বেলকুচি, শাহজাদপুর ও এনায়েতপুরের খুকনির তৈরি বেনারসি শাড়ি ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সাড়া ফেলেছে। ব্যবসায়ীদের চাহিদামতো কাপড় সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে তাঁত কারখানাগুলো। উৎপাদন বাড়াতে তাই দিন-রাত এক করে ফেলছেন শ্রমিকরা।
বেলকুচির শেরনগর, চন্দনগাঁতী বসুন্ধরা, তামাই, এনায়েতপুরের খুকনি কিংবা বেতিলের মতো তাঁত প্রধান কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সেখানকার নারী-পুরুষরা এখন দারুণ ব্যস্ত। নলীভরা, সুতাপারি করা, মাড় দেয়া, রং তুলিতে নকশা আঁকা, বুননসহ কাপড় তৈরির নানা কাজে তাদের এই ব্যস্ততা।
চলতি বছর করোনার বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ায় ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছেন তাঁতিরা। কেটে যাচ্ছে মন্দাভাব। এবার লাভের মুখ দেখার আশা করছেন তারা। কারণ শুধু দেশে নয়, তাঁত পল্লিগুলোতে তৈরি উন্নতমানের শাড়িসহ বিভিন্ন কাপড় এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। ঢাকার বড় বড় বুটিক হাউসগুলো তাদের পরিবেশকের মাধ্যমে কানাডা, আমেরিকা, ইংল্যান্ডসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাঁতের কাপড় বাজারজাত করছে।
বেলকুচির সোহাগপুর হাটের কাপড় ব্যবসায়ী আশরাফুল আলম পল্টন জানান, করোনার পর ভারতীয় ব্যবসায়ীরা সোহাগপুরসহ এনায়েতপুর ও শাহজাদপুর থেকে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১৫ কোটি টাকার কাপড় কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এতে এই অঞ্চলের তাঁত শিল্প প্রাণ ফিরে পাচ্ছে।
কলকাতার কাপড় ব্যবসায়ী গোপালচন্দ্র সেন জানালেন, সিরাজগঞ্জের তৈরি কাপড় কলকাতা, শুভরাজ, গঙ্গারামপুর, পাটনাসহ বড় বড় শহরে বিক্রি হচ্ছে। ভারতের চেয়ে এ দেশের কাপড়ের দাম তুলনামূলক কম, টেকসই এবং উন্নতমানের হওয়ায় তারা এখান থেকেই কাপড় কিনছেন। গোপালচন্দ্র এটাও জানালেন, বাংলাদেশি লুঙ্গির চাহিদা বেশি। তাই এখান থেকে লুঙ্গি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাঠাচ্ছে ভারতীয় রপ্তানিকারকরা।
বেলকুচির জ্যোতি শাড়ির মালিক শ্রী বৈদ্যনাথ রায় জানান, ক্রেতাদের নজর কাড়তে তারা ভারতের বিভিন্ন চ্যানেলের সিরিয়ালের নাম অনুযায়ী কাপড়ের নাম রাখছেন। এর মধ্যে এ বছর মন ফাগুন, অনুরাগের ছোঁয়া, কনক, লালপরী, নন্দিনী, চোখের তারা, স্বর্ণলতা নামে বাজারে নতুন নতুন শাড়ি এনেছেন বেলকুচি, শাহজাদপুর, এনায়েতপুরের তাঁতিরা। হাফ সিল্কের ওপর ঝুটের মনোমুগ্ধকর নকশা। কাপড় খুললেই স্বর্ণের মতো ঝলমল করে ওঠে, এমন একটি শাড়ির নাম রাখা হয়েছে- স্বর্ণলতা। শাড়িটি ইতোমধ্যেই ক্রেতাদের মন কেড়েছে। চাহিদা অনুযায়ী বর্তমানে বাজারে এর দাম দুই থেকে তিন হাজার টাকার মধ্যে।
স্বর্ণলতা কাপড় প্রস্তুতকারক দরগাপাড়া গ্রামের তাঁতি আজমল কবীর জানান, ক্রেতাদের বিষয়টি মাথায় রেখে ভারত থেকে জুট এনে তা দিয়ে হাতে বিভিন্ন নকশা করে স্বর্ণলতা শাড়ি তৈরি করা হচ্ছে। এই শাড়ির প্রকৃত নাম সাউথ কাতান। চাহিদা এত বেশি যে, উৎপাদনের আগেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।
বসুন্ধরার রাজরানী টেক্সটাইলের আব্দুল্লাহ জানান, দীর্ঘ দুই বছর চরম মন্দার পর ঈদ সামনে রেখে কাপড়ের বাজার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। ব্যবসায়ীরা অগ্রিম টাকা দিয়ে তাঁতিদের বাড়ি থেকে কাপড় নিয়ে যাচ্ছেন। অনেক তাঁতিই তার কারখানার কাপড় আগাম বিক্রি করে দিয়েছেন। কাপড়ের দামও তাই এখন একটু চড়া।
বর্তমানে বাজারে চাহিদার পরিমাণে কাপড় তৈরি করতে শ্রমিক সংকট রয়েছে বলে মনে করেন শেরনগরের কাপড় ব্যবসায়ী জামান টেক্সটাইলের অপু। কাপড়ের দাম বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে দফায় দফায় সুতা, রং ও অন্যান্য উপকরণের দাম বাড়ার কথাও জানান তিনি।
সুতা ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম দাবি করেন, তুলার সংকট এবং আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার কারণে স্থানীয় বাজারেও সুতার দাম বাড়ছে। তাঁত শ্রমিক রজব আলী জানান, তারা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে সপ্তাহে ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পান। ঈদকে সামনে রেখে পরিবারের চাহিদা মেটাতে বাড়তি রোজগারের আশায় রাত-দিন কাজ করে যাচ্ছেন এসব শ্রমিক।