দুই কৃষকের আত্মহত্যা: তদন্ত নিয়ে অসন্তোষ
স্টাফ রিপোর্টার: রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে দুই সাঁওতাল কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনাটি একদিন সরেজমিন তদন্ত করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি। এই কমিটি কৃষি সচিবের কাছে প্রতিবেদনও দিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) গভীর নলকূপে পানি ব্যবস্থাপনায় ছিল অব্যবস্থাপনা। কিন্তু দুই কৃষক কেন বিষপান করেছিলেন সে বিষয়ে এই প্রতিবেদনে কিছু বলা হয়নি। তাই আরও গভীর তদন্ত দাবি করা হয়েছে।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠন রক্ষাগোলা সমন্বয় কমিটি এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করেছে। শনিবার সকালে এনজিও ফোরামের রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলন করা হয়। এতে সহযোগিতা করে রক্ষাগোলা নিয়ে কাজ করা সংগঠন সেন্টার ফর ক্যাপাসিটি বিল্ডিং অফ ভলান্টারী অর্গানাইজেশন (সিসিবিভিও)। সংবাদ সম্মেলনে আত্মহত্যা করা কৃষক অভিনাথ মারান্ডির স্ত্রী রোজিনা হেমব্রম এবং রবি মারান্ডির বড় ভাই সুশীল মারান্ডিও উপস্থিত ছিলেন। তারা তদন্ত নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে রক্ষাগোলা সমন্বয় কমিটির সদস্য রনজিৎ পাহাড়িয়া বলেন, সরেজমিনে মাত্র একদিন গিয়ে খুবই দ্রুততার সাথে মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি তদন্ত করেছে। তারা জানতে পেরেছেন, এই তদন্ত প্রতিবেদনে প্রকৃত বিষয় উঠে আসেনি। তদন্ত কমিটিকে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার কৃষকেরা যেভাবে বক্তব্য দিয়েছিলেন তাও হুবহু আসেনি। তাই পুনরায় গভীর তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।
সংবাদ সম্মেলন থেকে আবারও দাবি করা হয়, শুধু বোরো ধানের খেতে পানি না দেওয়ার কারণে অভিনাথ ও তার চাচাতো ভাই রবি গভীর নলকূপের সামনেই বিষপান করেন। কিন্তু একটিপক্ষ তাদের মৃত্যুকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে। বলা হচ্ছে, চোলাই মদপানে তাদের মৃত্যু হয়েছে। রনজিৎ পাহাড়িয়া বলেন, আদিবাসীরা চোলাই মদ পান করেন। এটা তাদের সংস্কৃতি। এ জন্য তাদের মৃত্যু হয় না। এখন এই বিষয়টিকেই সামনে এনে ঘটনা ভিন্নখাতে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। বিএমডিএকে বাঁচানোর চেষ্টা হচ্ছে।
লিখিত বক্তব্যে রনজিৎ পাহাড়িয়া আরও বলেন, দুই কৃষকের আত্মহননের পেছনে বিএমডিএ’র গভীর নলকূপ অপারেটর সাখাওয়াত হোসেনের মতো জাতিবিদ্বেষী মানুষ যেমন দায়ী ঠিক তেমনি এই বরেন্দ্র অঞ্চলের সেচ কার্যক্রম পরিচালনাকারী সংস্থা বিএমডিএ’র অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম সমানরূপে দায়ী। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তদন্তে উঠে এসেছে সাখাওয়াত ১২৫ টাকা ঘন্টার পানি ১৩৫ টাকায় কৃষকদের কাছে বিক্রি করতেন। এই অনিয়ম বহুদিনব্যাপী চলমান থাকলেও কর্তৃপক্ষের কোন তদারকি ছিলো না।
সংবাদ সম্মেলনে ওই গভীর নলকূপের কিছু অনিয়ম তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, গভীর নলকূপের ট্রান্সমিটার পাহারা দেবার জন্য প্রতি মৌসুমে কৃষকদের কাছে থেকে জনপ্রতি ২০০-৩০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা উত্তোলন করা হত যা খরচের কোন হিসেব নেই। চেম্বার মেরামতের জন্য কৃষকপ্রতি ৫০ টাকা উত্তোলন করা হতো। সেচের পানি প্রদানের ক্ষেত্রে কোন সিরিয়াল অনুসরণ করা হতো না। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিদের ক্ষেত্রে সিরিয়াল থাকলেও ৮-১০ দিন ঘোরানো হতো। নলকূপ অপারেটর স্কিমভুক্ত জমিতে নিজের পাওয়ার টিলার ছাড়া অন্য কোন পাওয়ার টিলার ব্যবহার করতে দিতেন না এবং বেশি চার্জ আদায় করতেন।
অভিযোগ করা হয়, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিদের ক্ষেত্রে পানি না দেওয়ার ভয় দেখিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে বাড়ির কাজ করিয়ে নিতেন সাখাওয়াত। সেচের পানির জন্য পীড়াপীড়ি করলে কৃষকদের বলতেন ‘তোদের পানি দেয়া হবে না, পারলে কেস কর গা’। নলকূপের কিছু নষ্ট হলে ৫০০ টাকার খরচের জন্য কৃষকদের কাছে থেকে ৫ হাজার টাকা আদায় করতেন তিনি। চাষিদের সেচ কার্ড থাকলেও অপারেটর তার নিজের কার্ড ব্যবহারে বাধ্য করতেন। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি কৃষকদের গভীর রাত ছাড়া সেচের পানি দেওয়া হতো না। অপারেটর তার নিজস্ব আবাদী জমিতে জোরপূর্বক কম মজুরিতে কাজ করাতে বাধ্য করতেন। আদিবাসীদের বর্গা চাষের জন্য ১০ বিঘা জমি থাকলে পানি না দেওয়ার হুমকি দিয়ে ২ বিঘা জমি জোরপূর্বক বর্গা চাষের জন্য কেড়ে নিতেন সাখাওয়াত। দীর্ঘদিন ধরেই এসব চলে আসত। বিএমডিএ সেচ ব্যবস্থার নামে যে শোষণ যন্ত্র তৈরী করেছে তার দায় তারা এড়াতে পারে না।
সংবাদ সম্মেলন থেকে কিছু দাবি তুলে ধরা হয়। এগুলো হলো- কৃষক অভিনাথ ও রবির আত্মহত্যায় প্ররোচণা দেওয়ায় সাখাওয়াত হোসেনকে বিচারের মাধ্যমের শাস্তি নিশ্চিত করা, সেচ কার্যক্রমের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের জন্য বিএমডিএ কর্তৃপক্ষকে তদন্তের আওতায় এনে দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ, নলকূপ পরিচালনার ক্ষেত্রে কৃষকবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে নলকূপ অপারেটর হিসেবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিদের ও প্রান্তিক কৃষকদের অগ্রাধিকার এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিদের ও প্রন্তিক কৃষকদের পর্যাপ্ত পরিমাণে সেচের পানির অভিগম্যতার সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য বিধান তৈরি করা।
সংবাদ সম্মেলনে সিসিবিভিও’র সমন্বয়কারী মো. আরিফ, রক্ষাগোলা সমন্বয় কমিটির সভাপতি সরল এক্কা, সাবেক সভাপতি প্রসেন এক্কাসহ ক্ষুদ্র জাতিসত্তার কৃষকেরা উপস্থিত ছিলেন। গত ২৩ মার্চ গোদাগাড়ীর নিমঘুটু গ্রামের কৃষক অভিনাথ ও তার চাচাতো রবি বিষপান করলে তাদের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় পরিবারের করা আত্মহত্যার প্ররোচনা মামলার আসামি সাখাওয়াত হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি এখন কারাগারে।