ঢাকা | ডিসেম্বর ৩, ২০২৪ - ১১:১৭ অপরাহ্ন

পাতাল পানিশূন্য করছে বিএমডিএ

  • আপডেট: Tuesday, March 29, 2022 - 11:40 pm

 

স্টাফ রিপোর্টার: কয়েক দশক আগেও বরেন্দ্র অঞ্চলে তেমন ফসল হতো না। এর কারণ পানির সংকট। সে সমস্যার সমাধানে জন্ম নেয় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। ১৯৮৫-৮৬ সাল থেকে বিএমডিএ বরেন্দ্রজুড়ে গভীর নলকূপ বসাতে শুরু করে। তারপর ভূ-গর্ভস্থ পানি তুলে চাষাবাদ শুরু হওয়ায় সবুজে ভরে ওঠে বরেন্দ্রাঞ্চল। কিন্তু এখন দেখা দিয়েছে এক নতুন সংকট।

দিনরাত পানি তোলার কারণে পানিশূন্য হয়ে পড়ছে পাতাল। এখন কৃষক তার চাহিদামত পানি পাচ্ছে না। এলাকাভেদে বোরো ধানের জমিতে সেচের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে ৭ থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত। গভীর নলকূপের অপারেটররা বলছেন, আগের মত আর পানি না উঠছে না গভীর নলকূপে। ফলে কৃষককে পানি দিয়ে কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। আর এই পানি না পাওয়াকে কেন্দ্র করে গত ২১ মার্চ রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার নিমঘুটু গ্রামে দুই সাঁওতাল কৃষক বিষপান করে আত্মহত্যা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের গবেষকেরা দেখেছেন, বোরো ধানের মৌসুমে যান্ত্রিক ত্রুটি কিংবা বিদ্যুতের গোলযোগ না হলে সব সময়ই বরেন্দ্র অঞ্চলে বিএমডিএ’র গভীর নলকূপ চলে। এর ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিনিয়ত নিচে নেমে যাচ্ছে। প্রতিবছর যে পরিমাণ পানি নিচে নেমে যাচ্ছে তা আর পূনর্ভরণ হচ্ছে না। সমালোচনার মুখে ২০১২ সালের জুন মাস থেকে বিএমডিএ বরেন্দ্র অঞ্চলে নতুন করে গভীর নলকূপ বসানো বন্ধ করে দিয়েছে। তবে রাজশাহী বিভাগে এখনো ৮ হাজার ৮২৬টি গভীর নলকূপ চালু আছে।

এসব গভীর নলকূপ বরেন্দ্র অঞ্চলের পাতাল পানিশূন্য করছে। পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার (ওয়ারপো) এক জরিপে বরেন্দ্র অঞ্চলের পাঁচটি ইউনিয়নের ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে পানিই পাওয়া যায়নি। গত বছরের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত হাইড্রোলজিক্যাল মডেলিংয়ের মাধ্যমে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর ৫০টি জায়গায় প্রায় দেড় হাজার ফুট গভীর পর্যন্ত ‘বোরিং’ করে এই জরিপ চালিয়েছে ওয়ারপো। জরিপে কোথাও কোথাও পানিধারক স্তরেরই (অ্যাকুইফার) সন্ধান পাওয়া যায়নি। ওয়ারপো সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

ওয়ারপো জানায়, জরিপে রাজশাহীর তানোর উপজেলা পাচন্দর ইউনিয়ন, মুন্ডুমালা পৌর এলাকা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, নওগাঁর পোরশার ছাওড় ইউনিয়ন এবং সাপাহার উপজেলার সদর ইউনিয়নের বিশেষ কয়েকটি জায়গায় অ্যাকুইফার পাওয়া যায়নি। সাধারণত ১৫০ থেকে ২০০ ফুট মাটির গভীরে অ্যাকুইফার পাওয়া যায়। কিন্তু উচু বরেন্দ্র এলাকার কয়েকটি জায়গায় তা পাওয়া যায়নি। তবে এই এলাকাগুলোর আশেপাশে ছোট ছোট পকেট অ্যাকুইফার পাওয়া গেছে। সেখানে থেকে এখনো খাবার ও সেচের জন্য পানি তোলা হচ্ছে। আর যে এলাকায় পকেট অ্যাকুইফারেও পানি নেই সেখানকার মানুষকে অন্তত এক কিলোমিটার দূর থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে।

গত ২৫ মার্চ দুপুরে গোদাগাড়ীর পালপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, একটি গভীর নলকূপের পাশে বোরো ধানের গাছ বাতাসে দোল খাচ্ছে। এর পাশেই অনাবাদি পড়ে আছে কিছু জমি। নলকূপ অপারেটর মো. কালাম জানালেন, অনাবাদি জমির পরিমাণ ৫০ বিঘা। ওই জমিগুলোকে চাষের আওতায় আনা যায়নি নলকূপে পানি কম উঠছে বলে। পাশের একটি গভীর নলকূপ দেখিয়ে কালাম বললেন, ‘আমি সক্ষমতার বেশি জমি চাষ করতে দেইনি। কিন্তু ওই ডিপে বেশি জমি চাষ হয়েছে। সেখানে ১৫ দিন লাইন দিয়েও মানুষ পানি পাচ্ছে না।’

রাজশাহীর তানোর উপজেলার বাঁধাইড় ইউনিয়নের অনেক জমি পানির অভাবে অনাবাদি পড়ে রয়েছে। বাঁধাইড়ের জজটোলা গ্রামে গিয়ে প্রায় ১৫ থেকে ১৬ টি নতুন বাড়ি করতে দেখা যায়। এখান থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে একটি সাবমারসিবল পাম্প হচ্ছে তাদের খাবার পানির একমাত্র উৎস। নতুন বাড়ি করছেন সরল সরেন (২৭)। তিনি জানেন না যেখানে তারা বসতি স্থাপন করছেন সেখানে মাটির নিচে পানির স্তর আছে কি নেই। তিনি বলেন, নলকূপে পানি ওঠে না। সাবমারসিবল পাম্প বসালে পানি পাওয়া যেতে পারে এই ভরসায় বাড়ি করছেন। না পেলে এক কিলোমিটার দূরে আলপথে হেঁটে গিয়ে উচ্চাডাংগা গ্রাম থেকে পানি এনে খেতে হবে। এ ছাড়া তার আর কোন বিকল্প নেই।

এই ইউনিয়নের ঝিনাখৈর গ্রামের শ্যামলী হাঁসদাসহ আরও কয়েকজন নারীকে মাথায় করে খাবার পানি নিয়ে আসতে দেখা যায়। শ্যামলী বলেন, প্রায় এক কিলোমিটার দূর থেকে পানি নিয়ে আসতে হয়। বাড়ির আশে পাশের খাবার পানির কোনো উৎস নেই। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার বড়বুনগ্রামের একটি বাড়ির পাশের সাবমারসিবল পাম্প থেকে কৃৃষি জমিতে সেচ দিতে দেখা যায়। খাবার পানির জন্য ইউনিয়নে পরিষদ থেকে এই পাম্পটি বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়ির মালিক সেই পাম্প থেকেই ছয় বিঘা ধানের জমিতে পানি দিচ্ছেন। তিনি বলেন, গভীর নলকূপে আর আগের মতো পানি উঠছে না। জমি পড়ে থাকবে তাই খাবার পানির জন্য বসানো পাম্প থেকে বাধ্য হয়ে সেচ দিচ্ছেন।

বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূ-গর্ভস্থ পানি নিয়ে গবেষণার বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়ারপো’র মহাপরিচালক মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘সমন্বিত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়নে বাংলাদেশ পানি বিধিমালা ২০১৮ কার্যকরণ শীর্ষক কারিগরি সহায়তা প্রকল্প’ এর অধীনে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলায় এই জরিপ করা হয়েছে। আগামী ২৩ জুন পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ আছে। মেয়াদ শেষে জানা যাবে প্রকল্প এলাকায় কী পরিমাণ আহরণযোগ্য পানিসম্পদ রয়েছে। এই প্রকল্পের কাজ হচ্ছে পানির আহরণযোগ্য সীমা নির্ধারণ করা। প্রকল্প শেষে তারা সভা-সেমিনার করে মানুষকে এই তথ্য জানিয়ে দেবেন। তখন আহরণযোগ্য সীমার বেশি পানি কেউ উত্তোলন করতে পারবে না।

পানি সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএমডিএ’র নির্বাহী পরিচালক মো. আব্দুর রশীদ বলেন, ওয়ারপো দেড় হাজার ফুট গভীর পর্যন্ত ‘বোরিং’ করে এই জরিপ চালিয়েছে। আমরাও এক হাজার ফুট পর্যন্ত গভীরে গিয়েও পানি পাইনি। সেটা কয়েকটি এলাকায়। সেসব এলাকাকে গোটা বরেন্দ্র এলাকার চিত্র হিসেবে ধরে নিলে তো হবে না। তিনি বলেন, ভূ-গর্ভস্থ পানি শুধু বিএমডিএ একা তুলছে না। ব্যক্তিমালিকানায় সাবমার্সিবল পাম্প বসিয়ে পানি তুলে সেচ দেওয়া হচ্ছে। তাতেও পাতালের পানি কমছে। কিন্তু বৃষ্টিপাত হচ্ছে না বলে পানির রিচার্জও হচ্ছে না। এর ফলেই একটা সংকট দেখা দিচ্ছে। সে কারণে আমরা কৃষকদের বেশি সেচ লাগে না এমন ফসল চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ করছি।