ঢাকা | নভেম্বর ২৭, ২০২৪ - ১২:২৮ পূর্বাহ্ন

দুই সাঁওতাল কৃষকের আত্মহত্যার দায় কে নেবে

  • আপডেট: Monday, March 28, 2022 - 9:14 pm

সঞ্জীব দ্রং

২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে একটু লেখালেখির চেষ্টা করছিলাম। নিচু ভলিউমে টিভি অন করে রেখেছিলাম। বিটিভিতে একটি নাটক চলছিল মুক্তিযুদ্ধের ওপর। দেখলাম, নাটকে লো ভলিউমে ‘ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ গানটি বাজছিল। হঠাৎ বাদশা ভাইয়ের ফোন (ফজলে হোসেন বাদশা, এমপি)। তিনি বললেন, ‘রাজশাহীর খবর শুনেছেন?’ বললাম, ‘বাদশা ভাই, সরি, খবর মিস করেছি মনে হয়। কোন খবর? আমি দুই দিন একটু অসুস্থ ছিলাম, বৃহস্পতিবার বুস্টার ডোজ নিয়েছিলাম। খবরের কাগজ দেখিনি।’ তারপর বাদশা ভাই যে কাহিনি বললেন, তা অতিশয় মর্মস্পর্শী। তাঁর কাছ থেকেই জানলাম, রবি মারান্ডি (২৭) ও অভিনাথ মারান্ডি (৩৬) বিষপানে আত্মহত্যা করেছেন। দুজনেই কৃষক। সাঁওতাল।

দিনের পর দিন এই দুই ভাই বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) কাছে গভীর নলকূপ থেকে জমিতে সেচের পানির জন্য ধরনা দিলেও পানি পাচ্ছিলেন না। তাঁরা কর্তৃপক্ষকে বলেছিলেন, পানি না দিলে এমনিতেই তো না খেয়ে মরে যেতে হবে। তার চেয়ে তাঁরা আত্মহত্যা করবেন। বিএমডিএর কর্তাব্যক্তিরা হয়তো ভাবতে পারেননি এই দুজন সত্যিই আত্মহত্যা করবেন। দুই ভাই একসঙ্গে গভীর নলকূপের সামনে কীটনাশক পান করেন ২৩ মার্চ সন্ধ্যায়। রাতেই অভিনাথের মৃত্যু হয়। আর রবি মারা যান রাজশাহী মেডিকেল হাসপাতালে ২৫ মার্চ রাতে।

সাঁওতাল দুই ভাই মাঠে বোরো ধান চাষ করেছিলেন। দিনের পর দিন পানির জন্য ঘুরলেও তাঁদের খেতে পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়নি। এই দুই সাঁওতাল কৃষকের বাড়ি গোদাগাড়ীর নিমঘটু গ্রামে। বাদশা ভাই বলেন, প্রথমে পুলিশ মামলা নিতে চায়নি। তিনি থানায় গিয়ে বসে ছিলেন। অবশেষে মামলা নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় পত্রিকা সোনালী সংবাদ জানিয়েছে, রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেছেন, রবি হাসপাতালের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে ছিলেন। রাত আটটার দিকে তাঁর মৃত্যু হয়।

আমার ধারণা, বাদশা ভাই না থাকলে ক্ষমতাসীনেরা মামলা ভিন্ন খাতে নিয়ে যেত। এখনো শঙ্কা হয়, অপরাধী শাস্তি পাবে কি না? তাদের কখন গ্রেপ্তার করা হবে? একটি জাতীয় দৈনিকের রাজশাহী প্রতিনিধি গিয়েছিলেন ঘটনাস্থলে। তিনি তাঁর প্রতিবেদনে লিখেছেন, বাড়ির উঠানে অভিনাথের লাশ। লাশ ঘিরে বিলাপ করছেন মা, বোন রুপিনা মারান্ডি ও চাচাতো বোন সুমিতা টুডু। সাঁওতালি ভাষায় বিলাপ করায় তাঁদের কথা বোঝা গেল না।

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে আমরা সুন্দর সুন্দর কথা লিখেছিলাম। অঙ্গীকার করেছিলাম, ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার’ নিশ্চিত করব। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাস্তবে স্বাধীনতার ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে এই কথাগুলো সংবিধানে শোভা হয়ে থাকে, আর দেশে সাঁওতালদের মতো জাতিগত সংখ্যালঘু মানুষের জীবনে, গরিব কৃষকের জীবনে দুঃখ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে।

তবে সুমিতা টুডু বাংলায় বললেন, ‘আমরা কোথাও বিচার পাই না।’ অভিনাথদের টিনের একটি ঘর। ঘরের দরজায় হেলান দিয়ে নির্বাক দাঁড়িয়ে ছিলেন স্ত্রী রোজিনা হেমব্রম। রোজিনা জানান, তাঁদের ১০ ও ৬ বছরের দুই সন্তান। স্বামীই ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।

স্বামীর মৃত্যুর ঘটনায় রোজিনা হেমব্রম নলকূপের অপারেটর ও ওয়ার্ড কৃষক লীগের সভাপতি সাখাওয়াত হোসেনের বিরুদ্ধে থানায় আত্মহত্যা প্ররোচনার মামলা করেছেন। বাদশা ভাই তখন থানায় ছিলেন। তিনি না গেলে হয়তো ঘটনা অন্যভাবে সাজানো হতো, যেমন হয়ে থাকে আমাদের দেশে গরিব–অসহায় মানুষের সঙ্গে, সাঁওতালদের সঙ্গে। বাদশা ভাই নিমঘটু গ্রামে গিয়ে অভিনাথের মা সোহাগী সরেনকে সান্ত্বনা দেন। আমি বাদশা ভাইকে প্রশ্ন করলাম, ‘ঢাকার জাতীয় পত্রিকাগুলো ছাপেনি এই খবর?’ স্থানীয় একটি পত্রিকার খবরে জানতে পারলাম, থানার ওসি বলেছেন, আসামিকে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। আমি জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেনের সঙ্গে কথা বলেছি। রাজশাহীতে গণেশ মাঝি ও সুভাষ হেমব্রমের কাছে খোঁজ নিয়েছি। সব শেষ হয়ে গেছে দুই সাঁওতাল পরিবারের।

মনে হয় ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি ও লুণ্ঠন রাজত্বের কাছে সবাই অসহায় হয়ে পড়েছেন। আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, দলে কি ভালো কোনো লোক নেই? এই যে কৃষক লীগের সভাপতি, যাঁকে গভীর নলকূপের অপারেটরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যাঁর নামে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির অভিযোগ, এর চেয়ে ভালো কোনো লোক কি নেই? যাঁরা একটু ভালো, তাঁরা বোধ হয় কোণঠাসা হয়ে গেছেন। আমি খবর নিয়ে জানতে পারলাম, অভিনাথ ২৫ কাঠা জমি বর্গা নিয়ে ধান চাষ করছিলেন। রবি চাষ করছিলেন নিজের জমি। পানির অভাবে ধানের খেত শুকিয়ে যাচ্ছিল। কী নিষ্ঠুর পরিহাস, তাঁদের আত্মহত্যার পর ধানখেতে পানি দেওয়া হয়।

দেশে এই যে উন্নয়নের এত খতিয়ান, এত এত অবকাঠামো নির্মাণ, মাথাপিছু আয় বাড়তে বাড়তে এই করোনাকালেও নাকি হয়েছে ২ হাজার ৫৯১ ডলার, তবু কেন মানুষ বেদনার্ত থাকে?

একনেকে পাস হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার সব প্রকল্প। আবার বাজারে তেল, চাল, জিনিসপত্রের দাম দেখে হাহাকার করছে মানুষ। কেন তাদের জীবন থেকে আকাল যায় না? কেন টিসিবির পেছনে ভিড় করে দাঁড়ানো মানুষের কারণে দেশের ইমেজ নষ্ট হয়? আর রবি ও অভিনাথদের আত্মহননের পথ বেছে নিতে হয় ক্ষুধা আর অনটনের অনিশ্চয়তায়। নিশ্চয় এই উন্নয়নের মধ্যে বড় ভ্রান্ত আছে, মিথ্যা আছে, হিসাবের গরমিল আছে। বৈষম্যও তো আছেই। ক্ষমতাসীনদের বড় পছন্দ হলো পরিসংখ্যান, যা নিজেদের সুবিধামতো বানানো যায়। একটা গড় হিসাব দিলেই হলো।

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে আমরা সুন্দর সুন্দর কথা লিখেছিলাম। অঙ্গীকার করেছিলাম, ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার’ নিশ্চিত করব। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাস্তবে স্বাধীনতার ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে এই কথাগুলো সংবিধানে শোভা হয়ে থাকে, আর দেশে সাঁওতালদের মতো জাতিগত সংখ্যালঘু মানুষের জীবনে, গরিব কৃষকের জীবনে দুঃখ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে।

আশা করব, রোজিনা হেমব্রমরা আজ না হোক, ভবিষ্যতে কোনো এক দিন বিচার পাবেন। যা গেছে, ক্ষতি তো পূরণ হওয়ার নয়; তবু আমি চাই সরকার দুই সাঁওতাল পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা করুক। বর্গা জমির মালিকও যেন একটু সহানুভূতিশীল হন। দেশে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসীদের কাছ থেকে যোজন যোজন দূরে চলে যাওয়া রাষ্ট্র যেন অনুসন্ধানী হয়, মানবিক হয়।

বহুদিন পর ‘চোট্টি মুন্ডা ও তার তীর’ উপন্যাস বইটি আলমারি থেকে বের করি। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন চলে গেছে। তারপর পাকিস্তান। এখন স্বাধীন বাংলাদেশের অর্ধশত বছর। আগুনমুখা তির ছিল চোট্টি মুন্ডার হাতে, সঙ্গে মন্ত্রপড়া ধনুক। অবিচারে ভরে ওঠা এই সমাজে হয়তো চোট্টি মুন্ডারা কোনো দিন আর ফিরে আসবে না। মানুষের দুঃখও যাবে না।

সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী