গোদাগাড়ীর ওসির প্রত্যাহার, বিএমডিএ চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি
স্টাফ রিপোর্টার: রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় পানি না পেয়ে দুই কৃষকের আত্মহত্যার পর পালিয়ে যাওয়া বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) গভীর নলকূপ অপারেটর সাখাওয়াত হোসেনের বিরুদ্ধে আগেই লিখিত অভিযোগ হয়েছিল। কিন্তু বিএমডিএ গুরুত্ব দেয়নি। অভিযোগের তদন্তও হয়নি বলে জানিয়েছেন ঈশ্বরীপুর ও নিমঘুটুর কৃষকেরা।
স্থানীয় ওয়ার্ড কৃষক লীগের সভাপতি ও নলকূপ অপারেটর সাখাওয়াত হোসেনের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগটি হয়েছিল ২০২০ সালের ২৪ নভেম্বর। পরের অভিযোগটি ২০২১ সালের ১৮ নভেম্বর। দুটি অভিযোগপত্রই গ্রহণ করেছিল বিএমডিএ। অভিযোগ দুটির রিসিভড কপি পাওয়া গেছে। প্রথম অভিযোগপত্রে তিনজন এবং পরের অভিযোগপত্রে স্থানীয় অন্য পাঁচজন কৃষক স্বাক্ষর করেছিলেন। তারা সাখাওয়াতকে বাদ দেওয়ার দাবি করেছিলেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছিল, ঈশ্বরীপুর-২ গভীর নলকূপের অপারেটর সাখাওয়াত হোসেন কৃষকদের সঠিক সময়ে পানি দেন না। বোরো মৌসুমে তিনি পানি দিতে বিড়ম্বনার সৃষ্টি করেন। ওই গভীর নলকূপ থেকে গ্রামে খাবার পানি সরবরাহেরও ব্যবস্থা আছে। সাখাওয়াত এই পানি ঠিকমত সরবরাহ করেন না। এমনকি দুই’একদিন পানি দেওয়া বন্ধও থাকে। প্রথম অভিযোগটি বিএমডিএ’র গোদাগাড়ী জোন-২ এ দেওয়া হয়েছিল। তাতে ফল না পেয়ে দ্বিতীয় অভিযোগটি দেওয়া হয়েছিল নির্বাহী পরিচালকের কাছে।
এই অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএমডিএ’র নির্বাহী পরিচালক মো. আব্দুর রশীদ বলেন, এ রকম অভিযোগ অহরহ আসে। সাখাওয়াতের বিরুদ্ধে এসেছিল কি না তা এখন মনে পড়ছে না। দুই কৃষকের আত্মহত্যার পরও সাখাওয়াতকে রক্ষার চেষ্টা চলছে বলে আদিবাসী সংগঠনগুলো অভিযোগ করছে। এ প্রসঙ্গে বিএমডিএ’র এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা আমাদের মত করে তদন্ত করছি। রিপোর্ট দাখিল করার আগেই এসব বলা ঠিক না। আর তার বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা হয়েছে। সেটা পুলিশ তাদের মত দেখবে।’
টানা ১২ দিন ঘুরেও গভীর নলকূপ থেকে বেরো ধানের খেতে পানি না পেয়ে নিমঘুটু গ্রামের সাঁওতাল কৃষক অভিনাথ মারান্ডি এবং তার চাচাতো ভাই রবি মারান্ডি গত ২১ মার্চ বিষপান করেন বলে তার পরিবার অভিযোগ করছে। দুজনের মৃত্যুর পর অভিনাথের স্ত্রী রোজিনা হেমব্রম সাখাওয়াতের বিরুদ্ধে আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলা করেছেন। এ ছাড়া রোববার রাতে সাখাওয়াতের বিরুদ্ধে একই মামলা করেছেন রবির ভাই সুশীল মারান্ডি। ২১ মার্চ থেকেই সাখাওয়াতের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ উঠলেও তাকে আটক করা হয়নি। তিনি পুলিশ-প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সামনেই ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। মামলা হওয়ার পর তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। গোদাগাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল ইসলাম বলেন, প্রথম দিকে সাখাওয়াত থাকলেও এখন পলাতক। তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি।
সাখাওয়াতকে গ্রেপ্তার না করার কারণে গোদাগাড়ী থানার ওসি কামরুল ইসলামের প্রত্যাহার দাবি করা হয়েছে। দুই কৃষকের মৃত্যুর প্রতিবাদে সোমবার আয়োজিত এক মানববন্ধন কর্মসূচি থেকে এই দাবি জানানো হয়। একইসঙ্গে মৃত দুই কৃষকের পরিবার দুটিকে যৌক্তিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানানো হয়। বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সাহেববাজার জিরোপয়েন্টে এই বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের রাজশাহী জেলা কমিটি এর আয়োজন করে। এতে সংহতি জানিয়ে অংশ নেয় রাজশাহী মানবাধিকার জোট। কর্মসূচিতে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের জেলা কমিটির সভাপতি বিমল রাজোয়াড়।
কর্মসূচিতে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, অভিনাথের মৃত্যুর পর ওসি কামরুল ইসলাম তার স্ত্রী রোজিনার সাদাকাগজে সই নিয়ে অপমৃত্যুর মামলা করেন। তিনি শুরু থেকেই ঘটনা ভিন্নখাতে নেওয়ার চেষ্টা করেন। আমরা তার দ্রুত প্রত্যাহার চাই। তিনি বলেন, যে কৃষক খাদ্যের যোগান দেয় তার মৃত্যু আমরা মানতে পারি না। এই ওসি থানায় থাকলে মামলার সঠিক তদন্ত হবে না।
মানববন্ধনে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন সংগঠনের উপদেষ্টা দেবাশিষ প্রামানিক দেবু। তিনি বলেন, ওসি কামরুল ইসলাম প্রতিটি ঘটনায় আদিবাসীদের বিপক্ষে অবস্থান নেন। তিনি ক্ষমতাবানদের পক্ষে থাকেন। তার প্রত্যাহার না হলে আমরা কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলব। দেবু অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে অপারেটর সাখাওয়াতের গ্রেপ্তার দাবি করেন। তিনি দুই কৃষকের মৃত্যুর দায় বিএমডিএ’র ওপর চাপান এবং কর্মকর্তাদেরও শাস্তি দাবি করেন।
মানববন্ধনে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের রাজশাহী জেলা কমিটির সভাপতি কল্পনা রায়, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের উপদেষ্টা রফিকুল ইসলাম পিয়ারুল ও কৃষক নেতা মিনারুল ইসলাম কালু। আদিবাসী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক তরুণ মুন্ডার সঞ্চালনায় আরও বক্তব্য রাখেন, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক গনেশ মার্ডি, দপ্তর সম্পাদক সুভাষ চন্দ্র হেমব্রম, আদিবাসী যুব পরিষদের জেলা সভাপতি উপেন রবিদাস, আদিবাসী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নকুল পাহান ও বড়াইগ্রাম উপজেলা সভাপতি যাদু কুমার দাস।
এদিকে বরেন্দ্র অঞ্চলে পানি ব্যবস্থাপনায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও নলকূপ অপারেটর সাখাওয়াতের বিচারের দাবিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিএমডিএ’র চেয়ারম্যান বেগম আখতার জাহানেরও পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে। সোমবার দুপুরে উন্নয়ন সংগঠন পরিবর্তন কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে বলা হয়, বিএমডিএ’র কারণে দুই কৃষককে আত্মহত্যা করতে হয়েছে। তাই বিএমডিএ’র চেয়ারম্যানের পদত্যাগ এখন সময়ের দাবি। সংবাদ সম্মেলনে আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ গণেশ মার্ডি, রাজশাহী মহানগর সম্পাদক আন্দ্রেয়াস বিশ^াস, রুলফাউ এর নির্বাহী পরিচালক আফজাল হোসেন, আসাউস পরিচালক রাজকুমার সাঁও এবং পরিবর্তন পরিচালক রাশেদ রিপন বক্তব্য দেন।