ঢাকা | নভেম্বর ২৬, ২০২৪ - ৬:৫৩ পূর্বাহ্ন

রাতারাতি আবাদী জমি হচ্ছে পুকুর

  • আপডেট: Monday, March 21, 2022 - 11:31 pm

স্টাফ রিপোর্টার: পবা উপজেলাসহ বিভিন্ন উপজেলায় আবারো শুরু হয়েছে অপরিকল্পিত পুকুরখনন। তবে পুকুরখনন সিন্ডিকেটের সদস্যরা পরিকল্পিত ভাবেই ম্যানেজের মাধ্যমে চালিয়ে যাচ্ছে এই খননযজ্ঞ। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে রাতারাতি আবাদী জমি পুকুরে পরিনত হচ্ছে।

পবা উপজেলার অনেক মাঠেই তিন ফসলি জমিতে শুরু হয়েছে সংস্কারের নামে মাটি বিক্রির জন্য পুকুরখনন। চোর-পুলিশ খেলায় বিভিন্ন কারণে হেরে যাচ্ছে পুলিশসহ প্রশাসন। তবে এবারে পবা উপজেলার কর্ণহার বিলে নতুন সংযোগ হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গোরস্থান, ঈদগাহ মাঠ ও রাস্তাঘাটের উন্নয়নের নামে পুকুরখনন। উপজেলার শুধু কর্ণহার বিলেই নয় পারিলার ভবানীপুরেও দেদারসে চলছে পুকুরখনন। গতবছরের মত এবারের পারিলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক নবীবুর রহমানের ছত্রছায়ায় এসব পুকুরখনন হচ্ছে বলে একটি বিশ্বস্তসুত্রে জানা গেছে।

এদিকে পুকুর খনন বন্ধে উপজেলা ও জেলা প্রশাসনে আবেদন দিয়েও ফলাফল শূণ্যই থেকে যাচ্ছে। প্রেক্ষিতে একদিকে আবেদনকারিরা পড়ছে বিপাকে এবং অন্যদিকে খননকারিরা হচ্ছে উৎসাহিত।

পুকুরখননে জেলায় কমেছে খাদ্য উৎপাদন, হুমকিতে পড়েছে পরিবেশ। গত পাঁচ বছরে বাণিজ্যিক মাছের খামার বেড়েছে বহুগুণ। কমেছে চারণভূমি, সংকট বেড়েছে পশু খাদ্যের। কৃষি জমি কমেছে প্রায় এক হাজার হেক্টর । বর্ষায় জলাবদ্ধতায় ব্যাহত চাষাবাদ।

জানা গেছে, পানি শুকানোর পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন উপজেলায় একদিকে জোরেশোরে এবং অন্যদিকে চুপিসারে আবারো শুরু হয়েছে অপরিকল্পিত পুকুরখননযজ্ঞ। প্রশাসনের কর্মকর্তারা দিনে খননকাজে ব্যবহৃত মেশিন অকেজো করলেও রাতে ঠিকই চলছে খনন। আর এ চিত্র জেলার প্রায় সবক’টি উপজেলাতেই। বিশেষ করে পবা, মোহনপুর, দুর্গাপুর, গোদাগাড়ী ও তানোর উপজেলায় পুকুরখনন এখন একেবারে খোলামেলা।

এরইমধ্যে পবা উপজেলার বাগধানি, কর্ণহার, পারিলা ও দর্শনপাড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে জোরেশোরে চলছে পুকুরখনন। প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙ্গিয়ে চলছে এসব পুকুরখনন। চলতি বছরের গত ৯ জানুয়ারী অবৈধ পুকুর খনন সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের আবেদনে স্বাক্ষর করেছেন দর্শনপাড়া ইউনিয়নের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান শাহাদৎ হোসেন সাব্বির নিজেই। তবে এতেও কোন কাজ হয়নি। বর্তমানে তার ইউনিয়নেই বড় বড় পুকুরখনন হচ্ছে। ভূক্তভোগিরা আড়ালে তাকেও দোষারোপ করছেন।

পুকুরখনন বন্ধে একটি আবেদন থেকে জানা গেছে, দারুশা এলাকার মৃত হারুনার রশিদ ওরফে হারানের ছেলে পুকুরখনন সিন্ডিকেটের প্রধান মিনারুল ইসলাম বিগত কয়েক বছর থেকে কর্ণহার ও এর আশেপাশের বিল এলাকায় পরিবেশ ও রাস্তাঘাট নষ্ট করে বেপরোয়া ভাবে অবৈধ পুকুরখনন চালিয়ে যাচ্ছে। নতুনভাবে কর্ণহার গুচ্ছগ্রামের পাশে ১২৫ বিঘা পুকুরসহ আরো কয়েকটি পুকুরখনন করেছে। এবারে তিনি দারুশা সরিষাকুড়ি পশ্চিম পাড়ায় পুকুরখনন করছেন।

এদিকে রাজনৈতিক জবাবদিহিতা ও প্রশাসনের হস্তক্ষেপ ছাড়া এই অপরিকল্পিত পুকুরখনন কখনোই সম্ভব নয়। এছাড়াও জনসচেতনতা বৃদ্ধি খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে। পুকুর খননে মাছের লাভের চেয়ে অনেক বেশী ক্ষতি হচ্ছে কৃষিজীবী ও পরিবেশের। প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিদের মদদেই অপরিকল্পিত পুকুর খননের মহোৎসব চলছে বলে জানিয়েছেন সচেতনমহল, পরিবেশবাদি ও ভুক্তভোগিরা।

শুধুমাত্র অপরিকল্পিত পুকুরখননের জন্যই রাজশাহী জেলার বিভিন্ন ফসলের মাঠে দেখা দিয়েছে জমির প্রকৃতি পরিবর্তন, দীর্ঘ মেয়াদি জলাবদ্ধতা, পুকুরখননে মাটি বহনে গ্রামীণ রাস্তা নষ্ট, ফসল উৎপাদন ব্যাহত, বিলের পানি বেরুনোর নালা (খাল, ড্রেনেজ) ব্যবস্থা না থাকায় গ্রামের বাড়ি-ঘরে জলাবদ্ধতা, কৃষিজীবীদের মধ্যে বেকারত্ব বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা বেস্টনী নষ্ট। কৃষিকাজ না থাকায় যুব সমাজ মাদকে আসক্ত হচ্ছে এবং সর্বপরি নগরীতে ভাসমান শ্রমিক বাড়ছে। অপরিকল্পিত পুকুরখননের ফলে এসব না সূচক ও নেতিবাচক প্রভাব দেখেও অজানা কারণে নিশ্চুপ আছে প্রশাসন ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ। সচেতনমহল, পরিবেশবাদি ও ভুক্তভোগিরা পরোক্ষ ও প্রত্যেক্ষভাবেই দোষারোপ করে আসছে তাদের।

জেলার কৃষি দপ্তর বলছে, বাণিজ্যিকভাবে এসব পুকুর খনন হয়েছে আবাদি জমিতেই। অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খননে জলাবদ্ধতায় প্রতি বছরই ব্যাপক ফসলহানি হচ্ছে। ফসল হানির পরিমান প্রতিবছরই অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। পরিবেশের উপর বাড়ছে চাপ। এছাড়াও ফসল রোপনের আগেই ডুবে যাচ্ছে খনন এলাকা।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত মিনারুল বলেন, এলাকায় পুকুরখনন হলেই আমার নাম হয়। এছাড়াও এর আগে এই জমিতে পুকুর কাঁটার সময় সহকারী কমিশনার ভূমি শেখ এহসান উদ্দীন স্যার আমাকে ২ লাখ টাকা জরিমানা করেছিলেন। তাই এবারে পুকুরখনন করবো না বলেইছিলাম। কিন্তু হুজুরীপাড়া ইউপি চেয়ারম্যানের সহযোগিতার জন্যই এবং এলাকার রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, ঈদগাহ ও গোরস্থানের উন্নয়নের জন্যই গতবারের খননকৃত পুকুর থেকে বিনামূল্যে মাটি সরবরাহ করা হচ্ছে। অন্যান্য বছরে মাটি বিক্রি করলেও এবারে জনগণের উপকারের জন্যই পুকুরখনন করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

রাজশাহী জেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাসুম আল রশীদ সাংবাদিকদের জানান, যথাযথ আইনি পদক্ষেপের অভাবে প্রতিবছর দারুশা এলাকার বড়বিলসহ আশেপাশের বিলে অসংখ্য অবৈধ পুকুর খনন হচ্ছে। ফলে কৃষি জমি, বড়বিলের জীব বৈচিত্র ও রাস্তাঘাট নষ্ট হচ্ছে। তিনি এই অবৈধ কর্মকান্ড বন্ধে কার্যকর আইনি পদক্ষেপ গ্রহণে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

এব্যাপারে পবা উপজেলা সহকারি কমিশনার ভুমি শেখ এহসান উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, পুকুর খননের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান রয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকজনকে জরিমানাও করা হয়েছে।