দুদকের ভয়ে পাঁচ কোটি টাকা ঘরে রাখেন পাপিয়ার স্বামী সুমন
অনলাইন ডেস্ক: অবৈধভাবে উপার্জন করা হয়েছিল কোটি কোটি টাকা। এই টাকার খবর যাতে কেউ না জানে তাই ঘরে রাখা হয়েছিল গোপনে। তবে স্বামী মফিজুর রহমান সুমনের ঘরে রাখা পাঁচ কোটি টাকার খবর জেনে যান শামীমা নুর পাপিয়া। সুমন ভারতে যাওয়ার পরে পাপিয়া সেই টাকা নিয়ে ওঠেন ঢাকার বিলাসবহুল হোটেল ওয়েস্টিনে।
পাপিয়া-সুমন দম্পতির বিরুদ্ধে গুলশান থানায় করা অর্থ পাচারের একটি মামলার নথি থেকে এসব তথ্য জানা যায়। মামলাটির তদন্ত করেছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফিনান্সিয়াল ক্রাইমের পরিদর্শক মোহাম্মদ ইব্রাহীম হোসেন। গত ৯ জানুয়ারি এই মামলায় অভিযোগপত্র (চার্জশীট) দিয়েছেন তিনি।
সিআইডির পরিদর্শক ইব্রাহীম হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, মফিজুর রহমান সুমন অবৈধভাবে পাঁচ কোটি টাকা আয় করেছেন। দুদকের ভয়ে তিনি এই টাকা নিজের বাসার খাটের নিচে লুকিয়ে রাখেন। পরে তিনি ভারতে গেলে তার এই অবৈধ টাকা খরচ করেন তার স্ত্রী পাপিয়া। তিনি ওই টাকা দিয়ে বিলাসবহুল ওয়েস্টিন হোটেলে থাকেন। সেখানে তিনি তিন কোটি টাকার মতো বিল দেন।
২০২০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার হন মফিজুর রহমান সুমন ও তার স্ত্রী শামীমা নুর পাপিয়া।
অবৈধ অস্ত্র রাখার অপরাধে ওই বছরের ১২ অক্টোবর এই দম্পতির ২০ বছর কারাদণ্ড দেন আদালত। এছাড়া জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের করা একটি মামলায় এখন মফিজুর ও পাপিয়ার বিচার চলছে।
মামলার নথিতে দেখা যায়, সিআইডির কাছে ১৬১ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন মফিজুর রহমান সুমন। সেখানে তিনি বলেছেন, সুমন ১৯৯৯ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। কলেজে পড়া অবস্থায় নরসিংদীর তৎকালীন পৌর মেয়র লোকমান হোসেনের মাধ্যমে ছাত্রলীগে যোগ দেন।
নরসিংদী সরকারি কলেজে পড়ার সময় পাপিয়ার সঙ্গে সুমনের সম্পর্ক হয়। পরে তারা বিয়ে করেন। একপর্যায়ে পাপিয়া নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। গ্রেপ্তারের পর তাকে যুব মহিলা লীগ থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়।
আদালতে জমা দেওয়া সিআইডির অভিযোগপত্রে বলা হয়, অবৈধভাবে মাত্র ১৭ বছরের ব্যবধানে পাঁচ কোটি টাকার মালিক হন সুমন। মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, হুমকি, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তিনি এই টাকা আয় করেন।
সুমন সিআইডির কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছেন, তার আশঙ্কা ছিল অবৈধভাবে টাকা আয় করায় দুদক তার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে। তাই তিনি ব্যাংকে টাকা রাখতেন না। নগদ টাকা নিজের কাছেই রাখতেন। কিন্তু বিয়ের পর তার টাকা দেদার খরচ করতেন স্ত্রী পাপিয়া। এরপর থেকে মফিজুর টাকার বিষয়ে স্ত্রী পাপিয়ার কাছে তথ্য গোপন রাখতেন।…এভাবে তিনি বাসার খাটের নিচে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা জমা রাখেন। এ টাকার পুরোটাই ছিল অবৈধ।
১৯৯৬ সালে নরসিংদী পৌরসভার কমিশনার মানিক খুন হন। এ খুনের ঘটনায় সুমনকে আসামি করা হয়। এরপর থেকে তিনি সবসময় নিজের কাছে অবৈধ পিস্তল রাখতেন বলে জবানবন্দিতে বলেন মফিজুর।
মেয়র লোকমান খুন হলে নিজের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে মফিজুর আশঙ্কা বোধ করেন। সুমন সিআইডিকে বলেছেন, ২০১৯ সালে তার মনে হয়, তিনি খুন হয়ে যেতে পারেন। তখন তিনি ভারতে চলে যান। তখন বাসায় মফিজুরের রেখে দেওয়া টাকার কথা জানতে পারেন পাপিয়া।
এই মামলায় সিআইডির কাছে ১৬১ ধারায় পাপিয়াও জবানবন্দি দিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, ২০১১ সালে তিনি এসএসসি পাস করেন। পরে তিনি জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। এ পদ পাওয়ার পর ২০১৫ সালে কেএমসি এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খোলেন। একপর্যায়ে পাপিয়া পদ-বাণিজ্য, তদবির-বাণিজ্য, চাঁদাবাজির মতো অপরাধে জড়িত হন। আর তাকে এসব কাজে সহযোগিতা করেন স্বামী সুমন।
পাপিয়ার জবানবন্দি অনুযায়ী, ২০১৯ সালের অক্টোবরে তার স্বামী সুমন ভারতে যান। এরপর বাসা পরিষ্কার করতে গিয়ে বক্স খাটের ভেতরে অনেক টাকা দেখতে পান। ৫০০ ও ১ হাজার টাকার নোট গণনা করে তিনি মোট ৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা দেখতে পান।
সুমন-পাপিয়া দম্পতি ঢাকার তেজগাঁওয়ে কার এক্সচেঞ্জ নামের প্রতিষ্ঠানে কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন। নরসিংদীতে কেএমসি এন্টারপ্রাইজ ও কেএমসি কার ওয়াশ অ্যান্ড সলিউশন নামের প্রতিষ্ঠানে ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন তারা।
পরে পাপিয়া ঢাকার অভিজাত হোটেল ওয়েস্টিনে গিয়ে কক্ষ ভাড়া করেন। সেখানে তিনি কয়েক মাস অবস্থান করেন। ভাড়াসহ তার বিল আসে তিন কোটি ২৩ লাখ টাকা। তিনি এই টাকা নগদ অর্থে পরিশোধ করেছেন।
মামলার নথিপত্রের তথ্য অনুযায়ী, পাপিয়া হোটেল ওয়েস্টিনে ২৬টি কক্ষ ভাড়া করেছিলেন। অপরাধলব্ধ আয়ের প্রমাণ হিসেবে হোটেলের বিল পরিশোধের কাগজপত্র জব্দ করে আদালতের কাছে জমা দিয়েছে সিআইডি।