ঢাকা | নভেম্বর ২৫, ২০২৪ - ৯:৪৩ অপরাহ্ন

রাজশাহীর যাত্রাপালায় ‘ধীরেন অপেরার আলো’

  • আপডেট: Sunday, March 20, 2022 - 10:04 pm

 

স্টাফ রিপোর্টার: বাবা ধীরেনের যাত্রাদলে অভিনয় করতেন আলো রানী। দলে ছিলেন মোজাফফর মণ্ডলও। মঞ্চ ছেড়ে বাস্তব জীবনেও তাদের মন দেওয়া-নেওয়া হয়ে যায়। জানতে পেরে ধীরেন তার ‘ধীরেন অপেরা’ যাত্রাদল ভেঙে দেন। কিন্তু আলো-মোজাফফরের মন তিনি ভাঙতে পারেননি। দুজনেই পাড়ি দেন অজানায়। ঘর বাঁধেন।

আলো রানী পরিচিত হয়ে ওঠেন ‘আলো বিবি’ হিসেবে। তাঁর তিন ছেলের মধ্যে একজন মেরাজ ফকির। তিনি খানকা চালান। ধর্মের নামে ফতোয়া দেন। ছোট ছেলে পিয়ারের মন আবার যাত্রাদলে অভিনয়ে। আরেক ছেলে সিরাজ বউ নিয়ে থাকেন শহরে। আর গ্রামে মেরাজ ফকিরের সঙ্গে গ্যাদা ফকিরের প্রতিযোগিতার দ্বন্দ্ব।

এভাবেই এগিয়ে যায় যাত্রাপালা ‘ধীরেন অপেরার আলো’ যাত্রাপালার গল্প। অনেক দিন পর জীবনের শেষ সময়ে ধীরেন তাঁর মেয়ের খোঁজ পান। তিনি মেয়ের গ্রামে আসেন। তখন জানাজানি হয় মেরাজ ফকিরের মা আসলে একজন হিন্দু নারী। এই নিয়ে গ্যাদা ফকির ঘায়েল করতে শুরু করেন মেরাজ ফকিরকে। মেরাজও হয়ে ওঠেন ক্ষুব্ধ। ধর্মের দোহাই দিয়ে তিনি তাঁর মাকেই খুন করতে উদ্যোত হন।

আর তখনই মোজাফফর এবং তার দুই ছেলে সিরাজ ও পিয়ার ইসলামের পবিত্র বাণী আরবী থেকে বাংলায় তর্জমা করে মেরাজ ফকিরকে বুঝিয়ে দেন, মা মা-ই, ধর্ম ধর্ম-ই, দেশ-দেশ-ই। কোন কিছুর সঙ্গেই এসবের তুলনা হয় না। নিজের ভুল বুঝতে পেরে মেরাজ ফিরে আসেন মায়ের বুকে। আর বললেন, ‘ধর্মই মা, মা-ই ধর্ম।’

আব্দুল্লাহ আল-মামুনের ‘মেরাজ ফকিরের মা’ অবলম্বনে নির্মিত এই সামাজিক যাত্রাপালা শনিবার রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ রাসেল মাঠে করা মঞ্চে মঞ্চায়ন করা হয়। এটিকে যাত্রায় রূপ দেন আসাদ সরকার। নির্দেশনা দেন রহমান রাজু। যাত্রাপালাটি পরিবেশন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের ‘ফোকলোর রেপাটরি যাত্রাদল’। ফোকলোর বিভাগ, জেলা প্রশাসন ও জেলা শিল্পকলা একাডেমির ব্যবস্থাপনায় ৫০ জনের একটি দল যাত্রাপালাটি পরিবেশন করে।

‘যাত্রা শিল্পের নবযাত্রা’ শ্লোগানে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ‘দেশব্যাপী ১০০ নতুন যাত্রাপালা মঞ্চায়ন কর্মসূচি’র আওতায় বাংলাদেশ যাত্রা উৎসব-২০২২ শুরু করেছে। এই কর্মসূচির আওতায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এ উৎসব শনিবার থেকে শুরু হয়। রাত ৮টায় যাত্রা শুরুর সময় দেওয়া হয়। তার আগেই ভেতরে ঢুকতে বাইরে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সময় মতই শুরু হয় যাত্রা।

কথা বলে জানা গেছে, দর্শকদের বেশিরভাগই জীবনে প্রথমবারের মত কোন যাত্রাপালা উপভোগ করলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র মামুনুজ্জামান স্নিগ্ধ জানালেন, এই প্রথম তিনি যাত্রাপালা দেখলেন। তিনি বলেন, ‘যাত্রাপালা কেমন হয় তা শুধু বইপত্র আর নাটক-সিনেমায় দেখেছি। বাস্তবে কখনও যাত্রাপালা দেখার সুযোগ হয়নি। আজই প্রথম দেখলাম। প্রাণটা জুড়িয়ে গেছে। বাঙালীর হারানো এ কালচার ফিরিয়ে আনতে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়ায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে সাধুবাদ জানাই।’

যাত্রা দেখার পর চারুকলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র অভয় চরণ সূত্রধর বললেন, ‘সমাজের সাম্প্রদায়িক শক্তির জন্য আমরা আমাদের মা, মাটি ও ধর্মকে চিনতে ভুল করি। ধর্মের দোহাই দিয়ে ভেদাভেদ তৈরি করি। কিন্তু আমাদের মা, মাটি ও মানুষ যে সবকিছুর ঊর্দ্ধে তা এই যাত্রাপালার মাধ্যমে অনুধাবন করতে পারলাম।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার নিজেও এক ঘণ্টা ৪০ মিনিটের এ যাত্রাপালা উপভোগ করেন। পালা শেষে বললেন, ৪২ বছর পর তিনি যাত্রাপালা দেখলেন। সবশেষ ১৯৮০ সালে নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজ মাঠে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পালা দেখেছিলেন। তিনি বলেন, ‘যাত্রাপালা, আলকাপ, মাদারের গান আমাদের সংস্কৃতির অনুসঙ্গ। দিনে দিনে তা হারিয়ে গেছে। এটা ভাল লাগছে যে এখন আবার তা জাগ্রত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যাত্রাপালার নবযাত্রা শুভ হোক।’