ঢাকা | মে ১৭, ২০২৪ - ৮:৪৯ পূর্বাহ্ন

জোটগতভাবেই আগামী সংসদ নির্বাচনে যাচ্ছে ১৪ দল

  • আপডেট: Wednesday, March 16, 2022 - 11:06 am

অনলাইন ডেস্ক: নানা টানাপোড়েন সত্ত্বেও আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটগতভাবেই অংশ নেবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দল। এ জন্য জোটের মধ্যকার সমন্বয়হীনতা দূর করে এর কার্যক্রম আরও জোরদার ও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। সরকারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম মোকাবিলায় রাজনৈতিক কার্যক্রম নিয়ে শিগগির মাঠেও নামছে ক্ষমতাসীন এই জোটটি।

গতকাল মঙ্গলবার গণভবনে ১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠককালে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাও ১৪ দলীয় জোটের ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আগামী নির্বাচন আমরা একসঙ্গেই করব। এ জন্য ১৪ দলকে সক্রিয় রাখতে হবে। দেশ থেকে সাম্প্রদায়িক শক্তি এখনও পুরোপুরি নির্মূল হয়নি। তাই ১৪ দলকে একসঙ্গে থাকতে হবে, একসঙ্গে থাকবে, একসঙ্গেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে রাজনৈতিক কর্মসূচি বাড়াতে হবে। বিএনপি-জামায়াতের অপপ্রচার ও দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সক্রিয় হতে ১৪ দলকে আহ্বান জানিয়ে তিনি আরও বলেন, বিএনপিতে নেতৃত্বের সংকট রয়েছে। ক্ষমতায় গেলে তাদের নেতা কে হবেন? প্রধানমন্ত্রী কে হবেন? এই কারণে তারা নির্বাচন নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র করতে পারে। এ নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে। একইসঙ্গে তাদের অপকর্মের বিষয়ে জনগণকে বোঝাতে হবে।

বৈঠকে জোটের শরিক দলগুলোর নেতারাও সাম্প্রদায়িক শক্তি নির্মূল ও অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির ‘অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই’ ১৪ দলকে আরও কার্যকর ও শক্তিশালী করার তাগিদ দেন। একইসঙ্গে ভোজ্য ও জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ-গ্যাস ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধিসহ জনজীবনের নানা সংকট এবং নির্বাচনব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে তারা অসন্তোষ প্রকাশ করেন। সাম্প্রতিক সময়ে হেফাজতের তাণ্ডব ও দুর্গাপূজায় সাম্প্রদায়িক হামলাসহ সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বৃদ্ধিতে উদ্বেগ জানিয়ে তাদের দমনে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি তোলেন তারা।

বৈঠকে শরিক নেতাদের কেউ কেউ বিদ্যমান নির্বাচনব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতির প্রসঙ্গ তুলে ধরে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারি পদক্ষেপ প্রত্যাশা করেছেন। জোটের মধ্যে ‘অবমূল্যায়ন’য়ে কিছুটা ক্ষোভ ব্যক্ত করে তারা যথাযথ মূল্যায়নের দাবিও জানান।

দীর্ঘ তিন বছরের বেশি সময় পর জোটের শীর্ষ নেতা শেখ হাসিনার সঙ্গে ১৪ দলের নেতাদের এই বৈঠক হলো। এর আগে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের কিছুদিন আগে শরিকদের সঙ্গে বসেছিলেন আওয়ামী লীগ প্রধান। ওই নির্বাচনের মাধ্যমে টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় এলেও আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিসভায় মহাজোট ও ১৪ দল শরিকদের কারও ঠাঁই মেলেনি। এমনকি ওই সময় প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক নেতারা ১৪ দল শরিকদের ‘নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর’ অথবা ‘বিরোধী দলে থেকে’ নিজ নিজ দলীয় কার্যক্রম চালানোর পরামর্শ দেন। পরবর্তী নির্বাচনে শরিকদের নিজ নিজ প্রতীকে অংশগ্রহণের ইঙ্গিতও দেন প্রধানমন্ত্রী। এতে গত তিন বারের ধারাবাহিকতায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন জোটগতভাবে হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় ছিল।

আলোচনায় নানা প্রসঙ্গ :১৪ দল শরিকদের প্রতিটি দলের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক অথবা আহ্বায়ক-যুগ্ম আহ্বায়করা বৈঠকে যোগ দেন। কেবল আওয়ামী লীগ থেকে দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও ১৪ দলের সমন্বয়ক-মুখপাত্র আমির হোসেন আমু ছাড়া আরও তিন নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তাদের মধ্যে প্রতিটি দলের একজন করে শীর্ষ নেতার বক্তব্য শোনেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শরিক নেতাদের নানা প্রসঙ্গের আলোচনার তাৎক্ষণিক জবাবও অনেকটা খোলামেলাভাবেই দিয়েছেন তিনি।

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, দ্রব্যমূল্যের দিকে কঠোরভাবে নজর দেওয়া দরকার। সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ম্ফালন দমনটাও গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রদায়িক ঘটনাগুলোতে ‘আমাদের নেতারাও’ যুক্ত হয়ে পড়ছেন। এটাতেও অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তিকে নিয়ে জনমনে ভুল বার্তা যাচ্ছে। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোয় প্রশাসনের নগ্ন হস্তক্ষেপ দেখা যাচ্ছে। আমরা যেন আমলাতন্ত্রের কাছে বন্দি হয়ে না পড়ি। নির্বাচনে ইভিএম পদ্ধতি সাধারণ মানুষের বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে। এটা যেন কেবল কিছু জায়গায় পরীক্ষামূলকভাবে করা হয়। ১৪ দলের সব শরিক দলের ‘সম্মান রক্ষা’ এবং জোটের ঐক্যকে জোরদারের ওপরও গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান মেনন।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির দাম স্থিতিশীল রাখতে হবে। অন্যদিকে যারা জঙ্গিতাণ্ডব চালাচ্ছে, তারা যেন কোনোভাবেই ছাড় না পায়। দুর্নীতি রোধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের সব কার্যক্রমে ডিজিটাল পদ্ধতি চালুর দাবি জানান তিনি।

সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ূয়া বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং দুর্নীতি ও মাদকের বিস্তার বেড়ে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগী হলেই এগুলো দমন সম্ভব। আমলা ও ব্যবসায়ীদের ‘তোষণনীতি’র অবসানের দাবি করেন তিনি।

তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী জোট শরিকদের মূল্যায়নের দাবি তুলে ধরে বলেন, জেলা-উপজেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কমিটিগুলোতেও শরিক নেতাদের সম্পৃক্ত করতে হবে। তিনি বলেন, ওয়াজ মাহফিলের নামে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর নামে বাজে কথা ও অপপ্রচার চলছে। এসব বন্ধ করা দরকার।

ন্যাপের দায়িত্বপ্রাপ্ত কার্যকরী সভাপতি আইভি আহমেদ বলেন, দ্রব্যমূল্যের চাপে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের নাভিশ্বাস উঠেছে, এর অবসান হওয়া দরকার।

কমিউনিস্ট কেন্দ্রের আহ্বায়ক ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান বলেন, করোনাকালের প্রণোদনা অনেক জায়গায় শ্রমিকদের হাতে পৌঁছেনি। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা হতে পারে না। কারণ প্রণোদনার টাকা যার যার ব্যাংক হিসাবে চলে যায়। এরপরও বিষয়টিতে খোঁজ নেবেন তিনি।

তিন-ছয় মাস পরপর বৈঠকের প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীর ‘না’:১৪ দলকে সক্রিয় রাখতে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ থাকার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ ও সহযোগিতাও কামনা করেন শরিক নেতারা। ১৪ দলের সমন্বয়ক-মুখপাত্র আমির হোসেন আমু বলেন, ১৪ দল ঐক্যবদ্ধ আছে, থাকবে। বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে সক্রিয় রয়েছেন তারা। প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা পেলে এই কার্যক্রম আরও এগিয়ে যাবে।

জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, ২৩ দফা নিয়ে ১৪ দল করেছি। ২৩ দফার মূল চেতনা নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টির সভাপতি জাকির হোসেন ও বাসদের আহ্বায়ক রেজাউর রশীদ খান প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা পেলে ১৪ দলের কার্যক্রম আরও এগিয়ে যাবে বলে মত দেন। গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৪ দল দেশকে রাজাকারমুক্ত করবে।
গণআজাদী লীগের সভাপতি এসকে সিকদার সম্ভব হলে প্রতি তিন মাস পরপর অথবা ছয়-সাত মাস পরপর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শরিক নেতাদের বৈঠকের প্রস্তাবও দেন। তবে প্রধানমন্ত্রী এই প্রস্তাব নাকচ করেন।

বাংলাদেশ জাসদের অনুপস্থিতি প্রসঙ্গ :দীর্ঘদিন ধরে জোটগত কার্যক্রমে নিষ্ফ্ক্রিয় থাকা ১৪ দলের অন্যতম শরিক বাংলাদেশ জাসদ প্রধানমন্ত্রীর ডাকা বৈঠকে যাননি। অবশ্য ‘১৪ দল এখন মৃত, অতীত’ এমন কথা বলে বৈঠকে না যাওয়ার কথা আগেই জানিয়ে ছিলেন দলটির সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া।

বৈঠকে বাংলাদেশ জাসদের অনুপস্থিতির প্রসঙ্গটি তুলে ধরে ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান বলেন, বাংলাদেশ জাসদের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনায় বসা যেতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা, জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার, জাতীয় পার্টির (জেপি) সাধারণ সম্পাদক শেখ শহীদুল ইসলাম, ন্যাপের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন, কমিউনিস্ট কেন্দ্রের যুগ্ম আহ্বায়ক ডা. অসীত বরণ রায়, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ প্রমুখ।

সোনালী/জেআর