ঢাকা | মে ৪, ২০২৪ - ৭:২০ অপরাহ্ন

ফিলিস্তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নির্ধারণ করছে ইসরায়েল

  • আপডেট: Friday, March 11, 2022 - 7:46 pm

অনলাইন ডেস্ক: ইউক্রেন যুদ্ধের ডামাডোলে ফিলিস্তিন ইস্যু প্রায় হারিয়েই গেছে। প্রায় একই রকম অবস্থা দুই দেশে হলেও ইউক্রেন নিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যমের যতটা মনোযোগ, আগ্রহ, তার ছিটেফোঁটাও নেই ফিলিস্তিন নিয়ে; ছিলও না কখনো। কিছুদিন আগে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এক দীর্ঘ প্রতিবেদনে ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রণে অনুসৃত ‘ব্যবস্থা’-কে ‘জাতিবিদ্বেষী’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়। এর সঙ্গে এবার যুক্ত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নির্ধারণের বিষয়টি। ফিলিস্তিনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কারা পড়াতে পারবে, আর কারা পারবে না, এবার তাও নির্ধারণ করে দেবে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। মিডলইস্ট মনিটরে প্রকাশিত রাজনৈতিক ইসলাম ও মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক গবেষক নাসিম আহমেদের এক নিবন্ধে বিষয়টি আলোচনা করা হয়। নিবন্ধটি আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য বাংলায় অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান।

প্রতিটি দিনই ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি ‘জাতিবিদ্বেষী’ শাসন ও নিয়ন্ত্রণের জাঁতাকল আরও দৃঢ় হয়ে চেপে বসেছে। সেই জাঁতাকলের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়মিতই পড়ছে ফিলিস্তিনেদের ওপর। সম্প্রতি সেই তালিকায় যুক্ত হয়েছে আরও একটি নিয়ম। নিয়ামানুসারে এখন থেকে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষই ঠিক করবে কে বা কারা ফিলিস্তিনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াতে পারবেন। বিষয়টি এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের ওপর ‘অত্যন্ত স্বেচ্ছাচারী’ কায়দায় কয়েক হাজার ফিলিস্তিনির ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বিদেশ যেতে বাধা দিচ্ছে।

মে মাস থেকে কার্যকর হতে যাওয়া নতুন এই নিয়মানুযায়ী, ফিলিস্তিনের উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কেবল সেসব বিদেশিরাই পড়াতে পারবেন, যাদের ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেবে। শুধু তাই নয়, কেবল সেসব বিষয়ই পড়ানো যাবে, যা ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় বলে মনে করবে। স্পষ্ট করে বললে, কেবল ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কো-অর্ডিনেশন অব গভর্নমেন্ট অ্যাকটিভিটিস ইন দ্য টেরিটোরিস (সিওজিএটি) বিভাগ অনুমোদিত ব্যক্তিদেরই শিক্ষকতা করার সুযোগ দেওয়া হবে—যদি তাঁরা ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারেন এবং একাডেমিক ও আঞ্চলিক শিক্ষায় এমন উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হন, যা স্থানীয় অর্থনীতি, আঞ্চলিক সহযোগিতা ও শান্তির প্রচারে ভূমিকা রাখবে।

কিন্তু বিষয়টি কি আসলেই তাই? এত সহজ এবং সুন্দর। না, কোনোভাবেই নয়। এই নতুন নিয়মের মোদ্দাকথা হলো, ইসরায়েলি সেনা কর্মকর্তারা ফিলিস্তিনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কী পড়ানো ‘প্রয়োজন’ এবং কারা পড়াবেন সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। ফিলিস্তিনিদের শিক্ষার স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত করতেই ইসরায়েলের এই নতুন নীতি। এ ছাড়া কোনো কারণ ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে অভিযান, ছাত্রনেতাদের গ্রেপ্তার, বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগতদের অধ্যয়ন এবং পাঠদানে বাধা দেবে তারা।

নতুন এই নিয়ম নিয়ে ইসরায়েলি এক আইনজীবী বেন হিলেল সংবাদমাধ্যম হারেৎজকে জানিয়েছেন, এই নিয়মের মাধ্যমে ইসরায়েলিরা স্রেফ এই বিষয়টি আরও একবার দৃঢ়ভাবে জানান দিল যে, তারা প্রত্যেক ফিলিস্তিনি ও তাঁদের পারিবারিক জীবনের প্রতিটি উপাদানকে নিয়ন্ত্রণ করার আকাঙ্ক্ষা কোনোভাবেই ত্যাগ করতে প্রস্তুত না। হিলেল এই কঠোর নিয়ম ও বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে একটি আবেদনও করেছিলেন ইসরায়েলি আদালতে। কিন্তু ফলাফল কী হবে, তা অনিশ্চিত। কারণ, অ্যামনেস্টির ভাষ্যমতে ইসরায়েলের প্রতিটি সরকারই ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রণে তাদের তৈরি করা ‘ব্যবস্থা’ বা ‘সিস্টেম’ অন্ধভাবে অনুসরণ করেছে এবং দিনে দিনে তা আরও বিস্তৃত করেছে।

ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা খর্ব করার একাধিক পরিকল্পিত পদ্ধতির আরেকটি দিক হলো ফিলিস্তিনিদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ। ইসরায়েলভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হ্যামোকড জানিয়েছে, ২০২১ সালে অন্তত ১০ হাজার ৬০০ ফিলিস্তিনির ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল ইসরায়েল। তবে সর্বশেষ ওই পরিসংখ্যানে কেবল সরকারিভাবে নিষেধ করা ব্যক্তিদেরই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা ছাড়াই সীমান্ত থেকে যাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এর সহজ অর্থ, নিষেধাজ্ঞার তালিকা প্রকৃতপক্ষে অনেক লম্বা।

ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণ হিসেবে যে বিষয়কে সমানে আনা হয়েছে, তাকে ‘অত্যন্ত স্বেচ্ছাচারী’ বলে উল্লেখ করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা। তাঁরা জানিয়েছেন, ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য একটি মাত্র কথাই বলেছে, ‘আপনি হামাস কর্মী’। এবং বাকিদের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে কেবল মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কর্মী হওয়ায়। নাবলুসের এক প্রভাষক জার্মানিতে ছোটগল্প লেখকদের এক সম্মেলনে অংশ নিতে পারেননি কেবল এই কারণে যে, তিনি মানবাধিকার সংগঠনের সদস্য। এমন ভয়ংকর ঘটনাও ঘটেছে যে, এক ফিলিস্তিনি তাঁর ক্যানসারাক্রান্ত ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু তাঁকে জর্ডান সীমান্তে কিং হোসেন ব্রিজে (অ্যালেনবি ক্রসিং) আটকে দেওয়া হয়েছিল।

হ্যামোকডের উপনির্বাহী পরিচালক জেসিকা মন্টেল বলেছেন, ‘শিন বেত (ইসরায়েলের নিরাপত্তা সংস্থা) তাঁদের ‘ব্ল্যাক লিস্টে’ থাকা ১০ হাজারেরও বেশি লোককে যেকোনো মুহূর্তে চাইলে পশ্চিম তীর ত্যাগে বাধা দিতে পারে। এবং এমনটা করা হয় কোনো ধরনের পূর্ব নোটিশ, ব্যাখ্যা কিংবা কোনো ধরনের ওয়ারেন্ট ছাড়াই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁদের অ্যালেনবি ক্রসিংয়ে আটকে দেওয়া হয়।’

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইসরায়েলের কাজকে ‘জাতিবিদ্বেষী’ বলে আখ্যা দিয়েছে। ছবি: রয়টার্সফিলিস্তিনিদের জীবনের প্রতিটি দিক কীভাবে ইসরায়েলের আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অধীন, ওপরের দুটি ঘটনা তার সাম্প্রতিক উদাহরণ। কোনো ফিলিস্তিনিই এই ব্যবস্থা থেকে মুক্ত নয়, তা সে গাজায় অবরুদ্ধ ২০ লাখ ফিলিস্তিনি, অধিকৃত পশ্চিম তীর ও জেরুসালেমে বসবাসকারী ৩০ লাখ ফিলিস্তিনি, ‘ইসরায়েলের মূল ভূখণ্ডে’ দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বসবাসকারী ২০ লাখ ফিলিস্তিনি কিংবা ফিলিস্তিনে নিজ ভূমিতে ফেরার অপেক্ষায় থাকা ৫০ লাখ ফিলিস্তিনি—যে-ই হোক না কেন। যে পদ্ধতিতে এই ১ কোটি ২০ লাখ ফিলিস্তিনির অধিকার অস্বীকার করে ইসরায়েল, তাকে ‘ইহুদি আধিপত্য’-এর একটি ব্যবস্থা হিসেবেই চিহ্নিত করেছে জেরুসালেমভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন বি’টিসালেম।

ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের এমন জাতিবিদ্বেষী কর্মকাণ্ডের ওপর বিস্তারিত এক প্রতিবেদনে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল একে ‘ফিলিস্তিনিদের মানবিক উন্নয়নের দমন’ বলে আখ্যা দিয়েছে। ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে থাকা সমস্ত এলাকায় ফিলিস্তিনিদের প্রতি কয়েক দশকের ইচ্ছাকৃতভাবে অসম আচরণ ফিলিস্তিনিদের প্রান্তিক অবস্থায় ফেলেছে। শিক্ষাসহ জীবনের সব ক্ষেত্রেই ব্যাপক ‘ব্যবস্থাগত’ বা ‘সিস্টেমেটিক’ অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছে। বৈষম্যমূলক আচরণ, ইহুদিদের সুবিধা দিতে অধিকৃত ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি বসতি স্থাপন এবং ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সম্পদের অসম বণ্টন পরিস্থিতিকে কেবল আরও জটিল করে তোলে।

কিন্তু ইসরায়েল ও দেশটির সমর্থকেরা জাতিবিদ্বেষের বিষয়টিকে এই বলে হালকা করে দেয় যে, অন্যদের মতো ফিলিস্তিনিরাও তাঁদের নিজস্ব বিষয়াবলি পরিচালনা করতে স্বাধীন। এবং কাগজে-কলমে এল শান্তি চুক্তি অনুসারে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ নিজস্ব পুলিশ বাহিনী, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবহনের মতো রাষ্ট্রীয় পরিষেবাগুলো পরিচালনা করার ক্ষমতা রাখলেও বাস্তবে তা হয় না।

ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন, জর্ডান নদীর পশ্চিম তীর থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত সমস্ত ভূখণ্ডের একমাত্র নিয়ন্ত্রণকর্তা ইসরায়েল। এই ভূখণ্ডে বসবাসকারী ১ কোটি ২০ লাখ মানুষের মধ্যে ৬০ লাখ অ-ইহুদিদের জীবন ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত একটি ‘ব্যবস্থা’ বা ‘সিস্টেমে’র মধ্যে একাধিক পৃথক পৃথক শাসনব্যবস্থার অধীনে পরিচালিত হয়। বিপরীতে ইসরায়েলের ৬০ লাখ ইহুদি নাগরিক ইসরায়েলে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে, সব ধরনের স্বাধীনতা উপভোগ করে। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা কেবল এমন বাস্তবতা স্বপ্নেই দেখতে পারে। তাঁদের জীবন আক্ষরিক অর্থেই খণ্ডিত।

নাবলুসের একটি গ্রামে অবৈধ ইসরায়েলি বসতি স্থাপনের প্রতিবাদে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ফিলিস্তিনের পতাকা। ছবি: রয়টার্সসব মানবাধিকার গোষ্ঠী এই ব্যবস্থাকে ‘জাতিবিদ্বেষের’ একটি রূপ হিসেবেই আখ্যা দিয়েছে। বিগত কয়েক দশক ধরেই ইসরায়েলি সরকারগুলো ক্রমাগত এই জাতিবিদ্বেষী ব্যবস্থা তাঁদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলজুড়ে তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণ করেছে। সেই সময় থেকেই ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত পৃথক পৃথক শাসন ব্যবস্থার অধীন করে বৈষম্যমূলক আইন, নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে শাসন করে আসছে।