ঢাকা | ডিসেম্বর ২৬, ২০২৪ - ১০:৩৩ পূর্বাহ্ন

নাট্যেৎসবের পর্দা নামাল গঙ্গাপূত্রী

  • আপডেট: Monday, March 7, 2022 - 10:39 pm

 

স্টাফ রিপোর্টার: প্রাণ বাঁচাতে দৌঁড়ে একেবারে বটতলার শ্মশানে গিয়ে থামলেন সাংবাদিক স্বপন। সেখানে মধ্যবয়সী অদ্ভুত এক নারীর সঙ্গে তাঁর দেখা। নাম কুমারী। ভাল বাংলা, হিন্দি তো বলেনই, শুদ্ধভাবে ইংরেজিও বলেন। তাঁকে নিয়ে কৌতুহল বাড়ে সাংবাদিকের। জানতে চান পরিচয়। কুমারী বলেন, ‘আমি ডোম। মরা পোড়ানোর ডোম। ভাল ভাষায় লোকে যাকে বলে ‘গঙ্গাপূত্র’। কিন্তু আমি তো পূত্র না, পূত্রী। তাই ‘গঙ্গাপূত্রী’।

ভারতের মাখলা শিল্পকের ‘গঙ্গাপূত্রী’ নাটকের একটি দৃশ্য এটি। রাজশাহী থিয়েটার আয়োজিত ষষ্ঠ অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় নাট্যোৎসবের পঞ্চম দিন নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। রোববার রাতে জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে নাটকটি মঞ্চায়নের মধ্য দিয়েই পাঁচদিনের এই নাট্যেৎসবের পর্দা নামে। নাটকে সাংবাদিক চরিত্রে কলকাতার তিমির বরণ রায় এবং কুমারী চরিত্রে ঋতু গুপ্তা অভিনয় করেন। নাটকটির জন্য ভারত থেকে শুধু তাঁরা দুজনেই এসেছিলেন। তিমির বরণ নাটকের নির্দেশনা দেন।

এই নাটকে দেখানো হয় কুমার জাতের মেয়ে কুমারী কীভাবে ডোম হয়ে গেলেন। সাংবাদিককে বললেন, ‘জাতে আমরা চাড়াল নই গো। মরা পোড়ানোর কাজ আমাদের ঘরে বাপের জন্মেও কেউ করেনি। এই কাজ ডোম ছাড়া কেউ করে? ছিঃ! আমরা যে উঁচু জাত গো। উঁচু!’ অথচ ১১টি বছর ধরে ডোমের কাজ করছেন কুমারী। পরিবারের চোখে তিনি এখন মৃত। ডোমের ঘরের এক ছেলেকে ভালবেসে ডোম হতে হয়েছে তাঁকে। মাতন নামের ছেলেটি এখন বেঁচে নেই। পিটিয়ে মারা হয়েছিল তাকে।

কুমারী বললেন, ‘মেডিক্যাল স্টুডেন্ট হে হাম দোনো। একই কলেজ মে। লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট। কিন্তু মাতন ছিল সত্যিকারের গঙ্গাপূত্র। জাতে ডোম। ওদের চৌদ্দপুরুষের মরা পোড়ানোর কাজ। মাতন অন্যরকম হতেই চেয়েছিল। কোনদিন করেনি মরা পোড়ানোর কাজ। কিন্তু তাতে কি? চাড়ালের ছেলে তো! কর্ম না করুক, জাত-ধর্ম যাবে কোথায়? শালে ছোটা জাতকি ইতনি হিম্মত! মারদিয়া মাতনকো।’

টু শব্দটি না করে সাংবাদিক অপলক চেয়ে রইলেন। কুমারী বললেন, ‘ডোমের ঘরের ছেলে হাত বাড়াবে কুমোরের বাড়ির মেয়ের দিকে? যারা শুধুই মাটির জিনিস নয়, ঠাকুর দেবতার মুখ-মূর্তি গড়ে। যে পূজো মানুষ মাথায় তোলে, প্রণাম করে তার মাটিকে লাথিয়ে লাথিয়ে বানায় কুমোর। তাদের মেয়ের দিকে হাত বাড়াবে চাড়ালপূত্র! কেউ কি মানতে পারে? সর্বনাশ হয়ে যাবে না? তার চেয়ে ভাল মরে যাক। পিটিয়ে মারা হলো তাকে। এরপর ছিল ওর মরার শরীরটার মরণ। গাঁয়ের বিধান- গঙ্গাপূত্রের ঘরের ছেলে এমনিভাবেই পড়ে থাকবে। চিল-শকুনে ঠোকরা-ঠোকরি করবে।’

ডুকরে কেঁদে উঠে কুমারী বললেন, ‘না, গঙ্গাপূত্রের ছেলের মরা এভাবে পড়ে থাকবে না। বংশ বংশ ধরে যার চৌদ্দপুরুষ মানুষের শেষ কাজ করে এসেছে তারই শেষ কাজটা হবে না? আগুন পাবে না? পাবে না শেষ জলটুকুও? না, এটা হবে না। হতে দেবে না এ কুমারি। মাটি ছুঁয়ে শাঁপ দিচ্ছি, যে আটকাতে আসবে ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি কুমারি গঙ্গাপূত্রী।’ সেই থেকে শ্মশানে লাশ পুড়িয়ে যাচ্ছেন কুমারী।

হিন্দু ধর্মের জাতের ভেদাভেদ নিয়ে এই নাটকটি মঞ্চায়ন করা হয়। এর আগে উৎসব সমাপনী অনুষ্ঠিত হয়। এ অনুষ্ঠানে নাট্যেৎসব উপলক্ষে আয়োজিত শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার পুরস্কারও বিতরণ করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন রাজশাহীস্থ ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনের সহকারী হাইকমিশনার সঞ্জিব কুমার ভাটি।

বিশেষ অতিথি ছিলেন নাট্যজন মলয় ভৌমিক ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার। এ ছাড়াও বক্তব্য দেন, নাট্যজন তিমির বরণ রায় ও রাজশাহী থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম। সভাপতিত্বের পাশাপাশি অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন ‘ভোর হলো’র সভাপতি কামার উল্লাহ সরকার।