খেয়ালখুশির আমদানিতে ভোজ্যতেলে অস্থিরতা, দুষছে এফবিসিসিআই
অনলাইন ডেস্ক: দেশে ভোজ্যতেলের দাম ও মজুদ নিয়ে অস্থিরতার পেছনে নিত্যপণ্যটির আমদানি কেবল গুটিকয়েক করপোরেট কোম্পানির হাতে থাকাকেই দায় দিচ্ছেন দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই প্রেসিডেন্ট জসিম উদ্দিন।
করপোরেট সুবিধাতে দেশে ভোজ্যতেল আমদানির বিষয়টি টেনে জসিম উদ্দিন বলছেন, ‘বন্ডেড সুবিধায় ভোজ্যতেল আমদানি হলে সরকারের কাছে কেন্দ্রীয়ভাবে পণ্যটির আমদানি, মজুত ও সরবরাহ তথ্যটি থাকত। কিন্তু এখন পুরো প্রক্রিয়াটি চলে গেছে গুটিকয়েক করপোরেট কোম্পানির হাতে।’
রাজধানীর মতিঝিলে এফবিসিসিআই ভবনে সোমবার দুপুরে ভোজ্যতেল নিয়ে এক মতবিনিময় সভায় কথা বলছিলেন জসিম উদ্দিন। এসময় বৈঠকে এফবিসিসিআই পরিচালনা বোর্ডের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
জসিম উদ্দিন বলেন, ‘একেকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান নিজেদের মতো করে এলসি খুলে তেল আমদানি করছে। তারা যখন খুশি আমদানি করছে এবং বাজার সুবিধা অনুযায়ী বাজারজাত করছে। ফলে এখন কারা, কী পরিমাণ পরিশোধিত-অপরিশোধিত তেল আমদানি করছে, তার কোনো তথ্য সরকারের কাছে থাকছে না।’
‘পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো যদি সরকারের বন্ডেড ওয়্যারহাউস থেকে প্রয়োজনীয় চালান নিয়ে পরিশোধন করত এবং স্টক শেষ হলে আবার ওয়্যারহাউসে আসত, কিন্তু এখানে সেটা হচ্ছে না। বিশ্বের সব দেশে এ পদ্ধতিতেই ভোজ্যতেলের দাম নিয়ন্ত্রণ করা হয়, কিন্তু আমাদের দেশে সেটি হচ্ছে না’—যোগ করেন এফবিসিসিআই প্রেসিডেন্ট।
ভোজ্যতেলের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ায় সরকার বিব্রত হচ্ছে মন্তব্য করে জসিম উদ্দিন বলেন, ‘এর জন্য ভুক্তভোগী হচ্ছে ভোক্তারা। এ পরিস্থিতির উত্তরণে ভোজ্যতেলের আমদানি ও সরবরাহের জায়গাটি নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে থাকা জরুরি। এ প্রক্রিয়ায বন্ডেড সুবিধা নিয়ে তালিকাভুক্ত ব্যবসায়ীরা পণ্যটি আমদানি করবে।’
বর্তমানে নাগালের বাইরে চলে যাওয়া ভোজ্যতেলের দাম কমিয়ে আনতে আগামী তিন মাস আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে এফবিসিসিআই প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘দাম কমানোর সুবিধার্থে আগামী তিন মাস ভোজ্যতেল আমদানিতে ভ্যাট স্থগিত রাখার প্রস্তাব করছি আমরা। প্রতিবেশি দেশ ভারতে যেটা তিনবার ভ্যাট-ট্যাক্স সমন্বয় করা হয়েছে।’
ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে জসিম উদ্দিন বলেন, ভোজ্যতেলের দাম বাড়াবেন না, স্টক করবেন না। কেউ অসাধু উপায় নিলে আমরা তাদের পক্ষে নেই। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ছে এ অজুহাতে সবাই স্টক করছেন খোলা তেল। প্যাকেটজাত তেলের চেয়ে বাজারে খোলা তেলের দাম বেশি, এটা মানা যায় না।’
অনেকে বোতলের তেল খোলা হিসেবে বিক্রি করছেন। কিন্তু বিশ্ববাজারের আজ যে দাম বাড়ছে সে তেল তো দু-তিন মাস পরে দেশে আসবে তাহলে কেন আজ দাম বাড়বে? প্রশ্ন রাখেন এফবিসিসিআই সভাপতি। বর্তমান দাম ধরেই তিনি তেল বিক্রি করার আহবান জানান ব্যবসায়ীদের প্রতি।
মিল মালিকদের বাজারে তেল সরবরাহ ঠিক রাখার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা জানি, দেশে যে পরিমাণ তেল আছে তা দিয়ে রমজান কাভার করা যাবে।’
সভায় ভোজ্যতেল পরিশোধন ও সরবরাহকারী কোম্পানি সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, বাংলাদেশ এডিব অয়েলসহ সংগঠনের অন্যান্য সদস্য, বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতি, বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় ব্যবসায়ীরা জানান, বাজেটে ভোজ্যতেলে ভ্যাট ধরা হয়েছিল ৯ টাকা, সরকার এখন প্রতি লিটারে ভ্যাট নিচ্ছে ২৭ থেকে ৩০ টাকা। তারা বলছেন, বৈশ্বিক দাম বৃদ্ধি এবং বাড়তি ভ্যাটের কারণে দেশেও বেশি দামে তেল বিক্রি করতে তারা বাধ্য হচ্ছেন।
বৈঠকে মেঘনা গ্রুপের প্রতিনিধি তসলিম শাহরিয়ার বলেন, ‘গত বছর আমরা ১১৮০ ডলারে তেল আমদানি করেছি। এক বছর পর আজ বিশ্ববাজারে তেলের দাম ১৮০০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। একমাস আগে তেল এসেছে ১৪৫০ ডলারে, আজ বিশ্ববাজারে দাম চড়া।’
সিটি গ্রুপের বিশ্বজিৎ সেন বলেন, ‘কোনো কৃত্রিম সংকট নেই। আপনারা দেখে আসুন মিল থেকে দিনে ২৫০০ টন ডেলিভারি করছি। বাজারে কোনো ক্রাইসিস থাকার কথা নয়, তবুও ক্রাইসিস করছে। এখানে বাজার মনিটরিং জোরদার করা দরকার। পাশাপাশি আগামী কোরবানি পর্যন্ত ভ্যাট কমানোর দাবি জানাচ্ছি।’
পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মাওলা বলেন, ‘তেল নিয়ে মনে হচ্ছে কেয়ামত হয়ে যাচ্ছে। ১৪৯ টাকা পাইকারি বিক্রি করা হচ্ছে। অনেক মিল সরবরাহ করছে না বা দেরি করছে। সরবরাহ ঠিক রাখলে বাজার নিয়ন্ত্রণ থাকবে। মিল থেকে ঠিকমতো সরবরাহ করলে বাজার রিলাক্স থাকে।’
দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘প্রতি ১৫ দিন পর পর দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার দাবি জানাই। এতে প্রয়োজনে বাড়বে বা কমবে। আপনারা সরবরাহ ঠিক রাখলে সমস্যার কথা না।’
ব্যবসায়ীদের কথা শুনে এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আজকের কথা কিন্তু রেকর্ড হচ্ছে, সবাই যে দামের কথা বলছেন সে দামে বিক্রি করবেন। আমরা প্রয়োজনে বাজার মনিটরিং সেল বাড়াবো, খোঁজ রাখবো, সরকারকে সব জানাবো।’
উল্লেখ্য, বিশ্ববাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধির কথা জানিয়ে ব্যবসায়ীরা গতবছর ও চলতি বছরে বেশ কয়েকবার সরকারের কাছে আবেদন জানিয়ে তেলের দাম বাড়িয়ে নেন। সবশেষ গত ২৭ ফেব্রুয়ারি সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১২ টাকা বাড়ানোর দাবি জানান ব্যবসায়ীরা। তবে বাণিজ্যমন্ত্রণালয় সে দাবি নাকচ করে। রমজানের আগে আর দাম বাড়ানো হবে না বলে ব্যবসায়ীদের জানিয়ে দেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।
এরপর থেকেই বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরির খবর এসেছে। অনেক বাজারে খোলা তেল উধাও হয়ে গেছে বলে অভিযোগ এসেছে। দেশের অনেক জায়গাতেই ২০০ টাকা লিটারেও তেল বিক্রির অভিযোগ আসছে।