ঢাকা | এপ্রিল ২৬, ২০২৪ - ৬:৪৯ অপরাহ্ন

সর্বনাশা রাজশাহীর পদ্মা নদী

  • আপডেট: Wednesday, June 14, 2023 - 11:00 am

অনলাইন ডেস্ক: পদ্মা নদীকে বলা হয় সর্বনাশা। রাজশাহীর মানুষ সেই সর্বনাশা নদীরই রূপ দেখছে প্রতিনিয়ত। এ নদীতে ডুবে মারা যাওয়া মানুষের তালিকা দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে।

গত ছয় বছরে রাজশাহীর পদ্মায় অন্তত ৫৪ জন লাশ হয়ে ফিরেছেন। এর মধ্যে গত চার বছরে নদীতে গোসল করতে নেমে কিংবা পড়ে গিয়ে ডুবে মারা গেছেন ১৯ জন। যাদের অধিকাংশই শিক্ষার্থী।

এ সময়ে পুলিশ অজ্ঞাতপরিচয় ও অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করেছে অন্তত ১৪টি। গত ছয় বছরে নৌকা ডুবে মারা গেছেন আরও ২১ জন।

সর্বশেষ গত ১০ জুন বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলা শেষে নগরীর শ্রীরামপুর এলাকায় পদ্মায় গোসলে নেমে নিখোঁজ হন রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী সারোয়ার

সিয়াম ও রিয়াদ খন্দকার গালিব। রোববার তাদের দু’জনের লাশ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দল।

এ ঘটনার পর রাজশাহীর পদ্মায় ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা বন্ধে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নগরবাসীর চাওয়া, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে প্রশাসনের দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিয়াম ও রিয়াদ মারা যাওয়ার আগে গত ২৬ এপ্রিল বাজে কাজলা ফুলতলা সংলগ্ন পদ্মা নদীতে ডুবে মারা যান নগরীর বিনোদপুর কমলা হক ডিগ্রি কলেজের ছাত্র মো. ফাহিম।

গত ৩ মার্চ লালন শাহ মুক্তমঞ্চ এলাকায় গোসলে নেমে ডুবে মারা যায় কিশোর মোহাম্মদ সুহাঈল, ২৪ ফেব্রুয়ারি গোসলে নেমে চারঘাটে নদীতে ডুবে মারা যায় ১০ বছরের শিশু মো. নুর এবং ১৪ মে বাঘায় পদ্মা নদীতে নিখোঁজ হয় শিশু লাবনী খাতুন। নিখোঁজের ২১ ঘণ্টা পর তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

এর আগে গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর গোদাগাড়ীর সুলতানগঞ্জ এলাকায় পদ্মা নদীতে গোসল করতে নেমে ব্যাংক কর্মকর্তা সালাহউদ্দিন কাদের রূপম ও তাঁর স্ত্রী মানজুরি তানভীর নিশির মৃত্যু হয়।

ছয় বছরে নৌকা ডুবে মৃত্যু ২১ ২০২০ সালের ৬ মার্চ রাজশাহীর ইসলামপুর (শ্রীরামপুর) এলাকায় পদ্মায় নৌকা ডুবে ৯ জন মারা যান। পদ্মার ওপারে চরখিদিরপুর এলাকার রুমনের বাড়িতে বৌভাতের অনুষ্ঠান শেষে দুটি নৌকায় করে নগরীতে ফিরছিলেন সবাই। ফেরার পথে নগরীর শ্রীরামপুর এলাকায় ৪১ জনকে নিয়ে নদীতে নৌকা দুটি ডুবে যায়। এ ঘটনায় বর রুমনসহ ৩২ জনকে জীবিত উদ্ধার করা গেলেও নববধূ সুইটিসহ মারা যান ৯ জন।

গত বছরের ১৪ নভেম্বর শ্রীপুরে পদ্মা নদীতে খড়বোঝাই নৌকা ডুবে আসিয়া বেগম ও রাশেদা বেগম নামে দুই নারীর মৃত্যু হয়। ১১ সেপ্টেম্বর নগরীর মিজানের মোড় এলাকায় পদ্মা নদীতে ডিঙি নৌকা ডুবে তিনজন নিখোঁজ হন। যাদের লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এভাবে গত ছয় বছরে নৌকা ডুবে মারা যান ২১ জন।

৪ বছরে পদ্মা নদী থেকে ১৪ লাশ উদ্ধার
গত চার বছরে রাজশাহীর পদ্মা নদী থেকে অন্তত ১৪ লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। যার অধিকাংশই ছিল অজ্ঞাতপরিচয় ও অর্ধগলিত। ২০২২ সালের ৪ নভেম্বর নগরীর পঠানপাড়া লালন শাহ মুক্তমঞ্চ এলাকার পদ্মা নদী থেকে অজ্ঞাতপরিচয় এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে নৌ-পুলিশ।

একই বছরের ২ সেপ্টেম্বর নগরীর কাজলা জাহাজঘাট ও বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্ক এলাকা সংলগ্ন পদ্মা নদী থেকে দুটি লাশ উদ্ধার করা হয়। গত ১ এপ্রিল পাঠানপাড়া মুক্তমঞ্চ এলাকায় পদ্মা নদীতে এক যুবকের লাশ ভাসতে দেখেন এলাকাবাসী।

পরে নৌ-পুলিশ অজ্ঞাতপরিচয় ওই যুবকের লাশ উদ্ধার করে। ৪ এপ্রিল বড়কুঠি এলাকার পদ্মা নদী থেকে অজ্ঞাতপরিচয় আরেক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে নৌ-পুলিশ।

শ্রীরামপুরে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি
নগরীর শ্রীরামপুরেই গেল তিন বছরে পদ্মা নদীতে ডুবে মারা গেছেন ১৫ জন। পৃথক পাঁচটি ঘটনায় তাঁরা মারা যান। এর মধ্যে নৌকাডুবিতে ১১ জন এবং অন্যদের গোসলে নেমে মৃত্যু হয়েছে। সবশেষ গত শনিবার ওই দুই কলেজছাত্রের মৃত্যু হয়।

এর আগে ২০২২ সালে বিনোদপুর এলাকার বাসিন্দা এরফান আলীর মৃত্যু হয়। নৌকাডুবিতে দামকুড়ার সোনাইকান্দির সুমন আলীর স্ত্রী আসিয়া বেগম ও একই এলাকার আলম হোসেনের স্ত্রী রাশেদা বেগমের মৃত্যু হয়।

রাজশাহী নগরীতে তেমন কোনো পর্যটনকেন্দ্র নেই। ফলে পদ্মাপাড়ই এই নগরীর বাসিন্দাদের প্রধান বিনোদনকেন্দ্র। প্রতিদিনই নদীর পাড়ে বিভিন্ন বয়সী হাজার হাজার মানুষ বেড়াতে আসেন। ঘুরতে আসা অনেকেই গোসলেও নামেন পদ্মায়। এতে প্রায়ই স্রোতে ভেসে গিয়ে মারা যাচ্ছেন। তাই তাঁদের নিরাপত্তায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি সচেতন নাগরিকদের।

রাজশাহীর সমাজ বিশ্লেষক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আহমেদ সফিউদ্দিন বলেন, মৃত্যুর ঘটনার পেছনে সিটি করপোরেশন, প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায় রয়েছে। এই তিনটি সংস্থাই দায়িত্ব নিয়ে সমস্যার সমাধান করতে পারে। সিটিতে সাঁতার শেখার ব্যবস্থা নেই। ফলে এখনকার বাচ্চারা সাঁতার জানে না।
রাজশাহী ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার আব্দুর রউফ বলেন, নগরীর আশপাশে পদ্মা নদীর ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় সতর্কীকরণ সাইনবোর্ড লাগানোর জন্য ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসনকে জানানো হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, রাজশাহীতে পদ্মায় ডুবে মারা যাওয়াদের মধ্যে বেশিরভাগই শিক্ষার্থী। তারা সাঁতার জানে না। আবার যেসব নৌকা চলে, সেগুলোতে লাইফ জ্যাকেট নেই। ফলে কেউ নদীতে পড়ে গেলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা পৌঁছানো পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে না। অন্যান্য পর্যটন এলাকার মতো এখানেও ট্যুরিস্ট পুলিশ প্রয়োজন।

নৌ-পুলিশের রাজশাহী অঞ্চলের পুলিশ সুপার মো. রুহুল কবির খান বলেন, রাজশাহীর পদ্মা নদীতে যতগুলো ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্ট আছে, সেগুলো নৌ-পুলিশ চিহ্নিত করেছে। সেখানে সাইনবোর্ড লাগানো হবে এবং ওইসব জায়গায় মানুষকে নামতে দেওয়া হবে না। প্রশাসন এ বিষয়ে কঠোর। তিনি আরও বলেন, পুলিশ দিয়ে সব কাজ করা সম্ভব নয়। সে জন্য প্রয়োজন মানুষের সতর্কতা। সমকাল

সোনালী/জেআর